রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

কী ঘটতে যাচ্ছে তারা জানেন

রাশিয়ানরা যতই এগিয়ে আসছে, জীবন ততই কঠিন হয়ে আসছে। তাদের শহরের থেকে আক্রমণের শঙ্কায় আচ্ছন্ন। মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরেই রুশ বাহিনীর সম্মুখভাগের অবস্থান। প্রায় সব সড়কেই ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের দেখা মিলছে... ইউক্রেন বিশ্বাস করে, এর পূর্বাঞ্চলীয় ভূমি আবার বসবাসের জন্য নিরাপদ হবে। তবে এখন এটা পরিষ্কার নয় যে, যারা চলে যাচ্ছেন, তারা আবার কবে ফিরবেন। আসলে রাশিয়ানরা কোথায় গিয়ে থামবে, এর উত্তর দেওয়াই এখন কষ্টকর ...
যাযাদি ডেস্ক
  ১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
রুশ হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কস্তিয়ানতিনিভকা রেল স্টেশন

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের গতিপথে কেবল পরিবর্তনই আসেনি বরং খুব দ্রম্নতগতিতে এটি ঘটছে। 'আমরা জানি কী আসছে'- কস্তিয়ানতিনিভকায় নিজের ফ্ল্যাটের জিনিসপত্র প্যাকিং করার সময় একটি টেলিভিশনকে বলছিলেন মারিয়া। কিয়েভে ছেলের কাছে রওনা দেওয়ার আগে এগুলো পাঠিয়ে দেবেন তিনি। মারিয়া বলেন, 'আমরা ক্লান্ত এবং মুড ও প্যানিক অ্যাটাকে ভুগছি। একটানা বিষণ্নতা ও আমরা ভীত।'

গত ফেব্রম্নয়ারিতে রাশিয়া কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর আভদিভকা দখলের পর থেকে আরও পশ্চিমে অগ্রসর হচ্ছে এবং আরও কিছু গ্রাম দখল করে নিয়েছে।

ইউক্রেন বলছে, তাদের সেনারা অবস্থান ধরে রেখেছে। কিন্তু রাশিয়ার সেনারা এখন রণাঙ্গনের প্রায় ১১০০ কিলোমিটারজুড়ে পাঁচটি এলাকায় আক্রমণ করছে। এখন তারা দোনেৎস্ক অঞ্চলের পূর্বাঞ্চলে, যেখানে ইউক্রেনের যোদ্ধাদের ব্যাপক পরীক্ষার মুখে পড়তে হচ্ছে। পোকরোভস্ক, কস্তিয়ানতিনিভকা এবং ক্রামাৎরস্ক শহরগুলোর মানুষ এখন দ্রম্নত অগ্রবর্তী রুশ ফ্রন্টলাইনের মুখে, দখলদারিত্বের মুখোমুখি।

মারিয়া ও তার মা তেতিয়ানা বুঝতে পারছেন যে, রাশিয়ানরা যতই এগিয়ে আসছে, জীবন ততই কঠিন হয়ে আসছে। তাদের শহরের থেকে আক্রমণের শঙ্কায় আচ্ছন্ন। মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরেই রুশ বাহিনীর সম্মুখভাগের অবস্থান। প্রায় সব সড়কেই ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের দেখা মিলছে। সেখানেই ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ধ্বংস হওয়া একটি ট্রেন স্টেশনের কাছে একটি গির্জায় গোল্ড প্যানেল সংযোজন করছিলেন শ্রমিকরা। এই শহরের ঠান্ডা বাতাস এখন উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় পরিপূর্ণ। শহরটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়কার একটি শিল্প এলাকা। রাশিয়া এগুলো দখলের জন্য ধীরে ধীরে ইউক্রেনের একের পর এক শহর ধ্বংস করছে। সে কারণেই ভয় ছড়িয়ে পড়েছে এখানে।

মারিয়া জানান, তার মা এখানে থাকবেন। যদিও তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, তার মা তাকেই অনুসরণ করবেন। তিনি বলেন, এখানে সবজায়গাই এখন ভয় পাওয়ার মতো। পুরো দেশ আগুনের মুখে।' তার চোখ ভিজে যাচ্ছিল। একটি বিষয় হলো, যতটা সম্ভব নিজের বাড়িতে থাকা। কিন্তু আরেকটি বিষয়ক হলো- মৃতু্য বা রাশিয়ার আগ্রাসনের ঝুঁকি।

পুরো ইউক্রেন এখন যুদ্ধরত এলাকা; দোনেৎস্ক অঞ্চলসহ আরও চারটি এলাকা এখন রণাঙ্গন। সেখানকার ঘন ও প্রসারিত বনজঙ্গল এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হবে আপনি সংঘাতের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন। আপনি ৪০ কিলোমিটার দূর থেকেও ভারী গোলার শব্দ শুনবেন। কোনো একটি এলাকা থেকে আপনি দেখতে পাবেন, ইউক্রেনের ভূখন্ড ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য। আভদিভকার দিক থেকে যেতে দেখা যাবে ধোঁয়ার কুন্ডলী। শহরটি সম্প্রতি দখল করেছে রাশিয়া। আর ২০১৪ সাল থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হরলিভকা।

নিজের আকার, এয়ার সুপিরিওরিটি ও অস্ত্র বারুদ ব্যবহার করছে রাশিয়া। এর কাছেই চমৎকার উপত্যকা। সেখানকার প্রাকৃতিক ভুদৃশ্যশোভিত এলাকাটিতেই ইউক্রেনের সেনারা 'ফ্রন্ট লাইন' বানিয়েছে। ইউক্রেনের জেনারেলদের আশা, কিছু এলাকা সাময়িকভাবে তারা হারালেও দীর্ঘমেয়াদে এসব এলাকা মুক্ত করতে পারবেন তারা।

পুরো ফ্রন্ট লাইন এলাকাজুড়ে কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস আছে। যাদের রাশিয়াপন্থি মনে করে ইউক্রেনের মানুষ। যদিও সবার জন্য তা প্রযোজ্য নয়। কিছু মানুষ শুধু তাদের বাড়িঘর পরিত্যক্ত করে চলে যেতে রাজি নয় এবং প্রতিদিনকার বিপদসংকুল পরিস্থিতির সঙ্গে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। তবে ভ্যালেরি তেমন নন। নিজের বাড়িতে দুই দফা গোলাবর্ষণ হওয়ার পর তিনি জিনিসপত্র নিয়ে নাতির হাত ধরে গেছেন পিকআপ পয়েন্টে। অথচ রাশিয়ানরা যখন পাঁচ কিলোমিটার দূরে, তখনো তার প্রতিবেশীরা ঘর ছাড়তে রাজি হননি। পরে তিনি নাতিসহ পুলিশের একটি সশস্ত্র বাহনে উঠে বসেন। ভ্যালেরি বলেন, 'আমার জীবন আমি কাটিয়েছি। কিন্তু আমাকে এই বাচ্চাটিকে রক্ষা করতে হবে। ২০ বছর খনিতে কাজ করেছি, তাই কিছুতেই আমি ভয় পাই না। কিন্তু তার (নাতি) জন্য আমি উদ্বিগ্ন।'

১৪ বছর বয়সি ডেনি বলেলেন, তার শেষ বন্ধুটিও চলে গেছেন তিন সপ্তাহ আগে। রণাঙ্গনের ফ্রন্ট লাইন থেকে শিশুসহ পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেওয়া অত্যাবশ্যকীয়। যদিও অন্তত ১৫টি শিশু এখন তরেৎস্ক শহরে। পুলিশের উদ্ধারকারী দলের সদস্য অ্যান্টন প্রন ফ্রন্ট লাইন এলাকা থেকে লোকজনকে সরে যেতে সহায়তা করছিলেন। তিনি জানান, পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তিনি বলেন, তারা প্রতিনিয়ত গোলাবর্ষণ করছে। রাশিয়ানরা, এমনকি আবাসিক এলাকার বাড়িঘরে বোমাবর্ষণ করছে।

এখন কাছের ক্রামাতরস্ক শহরের ট্রেন স্টেশনটি সেনাদের আসার আর বেসামরিক নাগরিকদের তল্পিতল্পাসহ চলে যাওয়ার জন্য শেষ স্টপেজ। মূলত গোলাবারুদের শব্দই এখানে কাউকে স্বাগত জানায় কিংবা কারও বিদায় নেওয়ার কারণ হয়। ট্রেনের পস্ন্যাটফর্মে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নেওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। ট্রেনগুলোকে বিশেষ সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যাতে অন্তত ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা করা যায়। ২০২২ সালে সেখানে অন্তত ৬১ জন নিহত হয়েছেন। সেখানেই কিয়েভের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন আললা। তিনি বলেন, 'এক বছর আগে ভেবেছিলাম, পশ্চিমারা আমাদের সহায়তা করবে, কিন্তু এখন আর তা আশা করি না। মানুষ আগে বিশ্বাস করতো, কিন্তু এখন আর না।'

ফ্রন্টলাইন থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে লোজুভাৎকা গ্রাম। এই তীব্র শীতে গ্রামের এক বিধবা অ্যালোনা ওনিশচুক, তার পাঁচ বছর বয়সি মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন সমাধিতে; যেখানে আরও ১০ সেনার সঙ্গে চিরনিন্দ্রায় শায়িত তার স্বামী সের্হি অ্যালোশকিন। তার ৩৮ বছর বয়সি স্বামী ২০২২ সালের শেষের দিকে পূর্বাঞ্চলীয় শহর বাখমুতের কাছে লড়াই করার সময় নিহত হন।

দেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত এই গ্রাম থেকে অনেকটাই দূরে ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণ ফ্রন্ট। অথচ লড়াইয়ের আঁচ এসে এখানকার ছয় হাজার ৮০০ মানুষের গায়েও লেগেছে। সেখানেই দেয়াল ঘেরা এক বাগানে এখন সারি সারি সমাধি। সদ্য খনন করা মাটিতে কাঠের ক্রস, মৃতদের ছবি, ফুল আর হলুদ-নীল রঙের ইউক্রেনের পতাকা এখনো জ্বলজ্বল করছে। ইউক্রেনজুড়েই এখন এ ধরনের সমাধিক্ষেত্র চোখে পড়ে, যা রুশ আগ্রাসনের ভয়াবহ চিহ্ন বহন করে চলছে। ভয়ংকর এই যুদ্ধ এখন তৃতীয় বছরে প্রবেশ করেছে, যার আসলে কোনো শেষ আছে কি?

যদিও গ্রামে সরাসরি রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা বিরল। এরপরও ইস্পাত-উৎপাদনকারী শহর ক্রিভি রিহের কাছাকাছি হওয়ায়, যুদ্ধের সাইরেনে কান ঝালাপালা গ্রামবাসীর। কারণ, ওই শহরটি প্রায়ই আক্রান্ত হয়। ফলে লোজুভাৎকার তিনটি স্কুলের সবগুলোই প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে। তবে সেখানে অনলাইনে ক্লাস চলে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা যদিও ১০-১১ জনের বেশি না।

গত আগস্টে, জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ জানিয়েছিল, ইউক্রেনজুড়ে স্কুল-বয়সি শিশুদের এক-তৃতীয়াংশ সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগতভাবে ক্লাসে অংশ নেয়। কারণ, দেশের সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এত হাজার ৩০০টির বেশি স্কুল সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে।

আর নিহত? ইউক্রেনের সামরিক হতাহতের পরিসংখ্যানটি রাষ্ট্রীয়ভাবে গোপনীয়। এরপরও পশ্চিমাদের ধারণা, যুদ্ধে কয়েক হাজার সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও কয়েক হাজার। এই দুই বছরে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রম্নয়ারি ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে পুতিনের সেনাবাহিনী।

বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউক্রেনীয় সরকারের যৌথ সমীক্ষা অনুসারে, যুদ্ধের ফলে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচু্যত হয়েছেন অন্তত ৩০ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দ্বারে দ্বারে আশ্রয় চাইছেন আরও ৫০ লাখ ৯০ হাজার ইউক্রেনবাসী। এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত? লোজুভাৎকার ২৩ বছর বয়সি আনাস্তাসিয়া বলেন, 'লুহানস্ক, দোনেৎস্ক ও ক্রিমিয়ার জন্য আমার প্রাণ কাঁদে। কারণ, ওগুলো আমাদের অঞ্চল। সেখানে আমাদের লোকেরা বাস করেন। তাই তার মতে, আমাদের হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।' শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের লড়াই চালিয়ে যাওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন আনাস্তাসিয়া।

ইউক্রেন বিশ্বাস করে, এর পূর্বাঞ্চলীয় ভূমি আবার বসবাসের জন্য নিরাপদ হবে। তবে এখন এটা পরিষ্কার নয় যে, যারা চলে যাচ্ছেন, তারা আবার কবে ফিরবেন। আসলে রাশিয়ানরা কোথায় গিয়ে থামবে, এর উত্তর দেওয়াই এখন কষ্টকর। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ, রয়টার্স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে