ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার পুলিশ প্রধান মাহমুদ সালেহকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরাইল। তার সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন পুলিশের উপপ্রধানও। সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ইসরাইলি যুদ্ধবিমান খান ইউনিসের আল-মাওয়াসির কথিত 'মানবিক জোনে' হামলা চালায়। সেখানে একটি তাঁবুতে ছিলেন মাহমুদ সালেহ। এতে মাহমুদ, তার সহযোগীসহ অন্তত ১১ জন নিহত হন। গাজার স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ইসরাইলি বর্বরতায় গত দেড় বছরে গাজায় ৪৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মৃতু্য হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৫ হাজারের বেশি মানুষ।
হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে যুদ্ধবিরতির আলোচনা চলছে। এরমধ্যে উপত্যকাটির পুলিশ প্রধানকে হত্যার ঘটনা ঘটল। দখলদার ইসরাইল শুধুমাত্র হামাসের যোদ্ধাদের লক্ষ্য করার দাবি করলেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দায়িত্বে থাকা পুলিশ, পৌরসভার কর্মীদের ছাড়ছে না তারা। এতে গাজার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। যার ফলে সেখানে জাতিসংঘের পাঠানো ত্রাণ লুটপাটের ঘটনাও ঘটছে।
ইসরাইলি বাহিনীর হেফাজতে নয় মাস থাকার পর গত জুলাই মাসে মুক্তি পান মোয়াযায ওবাইয়াত। একসময়ের বডিবিল্ডার ওবাইয়াত তখন থেকে অন্যের সহায়তা ছাড়া ঠিকমতো চলাফেরাও করতে পারেন না। মুক্তির তিন মাস অতিবাহিত না হতেই অক্টোবরে নিজ বাড়ি থেকে আবারও ইসরাইলি বাহিনীর হাতে আটক হন তিনি। ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্সে মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব খবর জানা গেছে। ৩৭ বছর বয়সী মোয়াযায পাঁচ সন্তানের জনক। দ্বিতীয় দফায় আটক হওয়ার আগে বেথেলহেম সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তার পিটিএসডির উপসর্গ ধরা পড়ে। চিকিৎসকের নথির কপি যাচাই করেছে রয়টার্স। সেখানে লেখে আছে, হাজতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মোয়াযায। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, পারিপার্শ্বিকতার ভয়াবহতা ও মারাত্মক মানসিক উদ্বেগ তার অসুখের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ডিসেম্বরে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলো গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে আটঘাট বেঁধে আবার মাঠে নামে। তখন থেকেই ইসরায়েলি বন্দিশালায় আটক ফিলিস্তিনিদের ওপর চলা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। চুক্তিটি কার্যকর হলে, গাজা যুদ্ধের সময় ও আগে আটক হাজারও ফিলিস্তিনির বিনিময়ে হামাসের হাতে থাকে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত হতে পারে। ফিলিস্তিনি বন্দি বিষয়ক পরিষদের প্রধান ও পশ্চিম তীরের সরকারি কর্মকর্তা কাদৌরা ফারেস বলেছেন, সম্ভাব্য চুক্তির আওতায় মুক্তি পাওয়া বন্দিদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষত সারিয়ে তুলতে তাদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন হবে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধের ১৪ মাসে আটক হয়েছিলেন, এমন চারজন ফিলিস্তিনির সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। তাদের সবাইকে কোনও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই অবৈধ সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অজুহাতে মাসের পর মাস আটকে রাখা হয়েছিল। বন্দিদশার বর্ণনা দিতে গিয়ে সবাই বলেছেন, রক্ষীদের দ্বারা প্রহার, অনাহারে রাখা ও ঘুমাতে না দেওয়া ছিল প্রায় নৈমিত্তিক বিষয়। অবশ্য তাদের দাবির সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি রয়টার্স। গত আগস্টে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দাবি করা হয়, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরাইলি বন্দিশালায় মারধর, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন আটক ফিলিস্তিনিরা। সেখানে অবশ্য ৭ অক্টোবর হামাসের হামলাকেও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইসরাইলি বন্দিশালায় নির্যাতন ও ধর্ষণের প্রতিবেদনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল ওয়াশিংটন। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে, বন্দী ফিলিস্তিনিদের ওপর পরিকল্পিত ও রাষ্ট্র অনুমোদিত নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে ইসরায়েলি বাহিনী। তবে কয়েকজন বন্দি গাজাবাসীর ওপর চলা নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে তারা। বন্দীদের ওপর কেমন আচরণ করা হয়, জানতে চাইলে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন গাভিরের কার্যালয় থেকে রয়টার্সকে বলা হয়, অপরাধীদের জন্য যথাযথ সুযোগ সুবিধাই নিশ্চিত করা হয়েছে। সবকিছুই সেখানে আইন অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে।
গাজা যুদ্ধে ইসরাইলি বর্বরতা দুই শতাধিক
নবজাতকসহ ১১০০ শিশু নিহত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখন্ডে ইসরায়েলি বর্বরতায় প্রায় হারিয়েছে প্রায় ১১০০ শিশু। নিহত এই শিশুদের মধ্যে নবজাতকের সংখ্যা দুই শতাধিক। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনে প্রাণ হারিয়েছে তারা। বুধবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ১১০০ ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে বলে বুধবার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ২৩৮ নবজাতকসহ ১,০৯১ শিশু প্রাণ হারিয়েছে।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ গত সোমবার জানিয়েছে, অবরুদ্ধ এই ভূখন্ডে ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে শীতের কারণে ঠান্ডায় জমে ছয় শিশুসহ কমপক্ষে সাতজন মারা গেছে। এদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরে চলমান ইসরায়েলি গণহত্যার মধ্যে প্রায় ১২ হাজার ৯৪৩ জন ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন এবং আরও ২১ হাজার ৬৮১ জন আহত হয়েছেন বলে ফিলিস্তিনি তথ্য কেন্দ্রের বরাতে প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত মঙ্গলবার দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হামলা চালিয়ে হতাহত করার পাশাপাশি আরও ৫৪২ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া ইসরায়েলি হামলায় নিহত শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মীর সংখ্যা ৬৩০ জন এবং আহত হয়েছেন আরও ৩ হাজার ৮৬৫ জন।
মন্ত্রণালয় আরও উলেস্নখ করেছে, গাজায় চলমান যুদ্ধে ৪২৫টি স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ভবন এবং এর পাশাপাশি ইউএনআরডবিস্নউএ-অধিভুক্ত ৬৫ স্কুলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং পশ্চিম তীরে ১০৯টি স্কুল ও সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।
উলেস্নখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন আন্তঃসীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। হামাসের সেই আন্তঃসীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ মনে করছে, গাজা উপত্যকা জুড়ে ধ্বংস হওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও ১০ হাজারেরও বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছেন। মূলত গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরায়েল অবরুদ্ধ এই ভূখন্ডে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
ইসরাইল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।
গত মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।