মুঘল সম্রাট নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন চুনার দুর্গ (বর্তমান উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ) দখল করতে পারতেন। কিন্তু সেখানকার শাসক শের খান (শেরশাহ সুরি) হুমায়ুনের আনুগত্য মেনে নেন। সেসময় শের খান জানান, তিনি দুর্গে থাকতে চান হুমায়ুনের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে। একই সঙ্গে, আস্থা অর্জনের জন্য শের খান তার পুত্রের নেতৃত্বে একটি অশ্বারোহী দল মুঘল বাহিনীর সঙ্গেও পাঠান। সম্রাট হুমায়ুন ১৫৩০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর বাবরের মৃতু্যর পর সিংহাসনে বসেন। তিনি শের খানকে দুর্গে রেখে গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহের দরবারে যাত্রা করেন। জেমস ট্যালবয়েস হুইলার তার বই 'দি হিস্টোরি অব ইন্ডিয়া ফ্রম দি আর্লিয়েস্ট এজেস' বইয়ে লিখেছেন, এটি ছিল শের খানের একটি কৌশল, যার ফলে হুমায়ুন প্রতারিত হন এবং ভারতবর্ষের সিংহাসন হারান। গুজরাট থেকে ফিরে হুমায়ুন দেখতে পান, শের খান তখন বাংলার অধিপতি হয়ে গৌড় দখল করেছেন। হুমায়ুন বাংলার দিকে অগ্রসর হতে চাইলে চুনার দুর্গ তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এটি জয় করতে তার ছয় মাস লেগে যায়।
অগ্রসর হওয়ার পর তিনি দেখতে পান, আফগানরা গঙ্গা ও রাজমহল পাহাড়ের মধ্যবর্তী সরু পথটি অবরুদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ তারা সরে গেলে পথ পরিষ্কার হয়। তবে, হুমায়ুন গৌড়ে পৌঁছালে বুঝতে পারেন, তিনি পরাজিত হয়েছেন।
শের খান এতদিন মুঘল বাহিনীকে বাংলার বাইরে আটকে রাখেন যতদিন তার প্রয়োজন ছিল। গৌড় লুট করে সম্পদ সুরক্ষিত স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং বর্ষাকাল পর্যন্ত হুমায়ুনকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। বর্ষাকালে মুঘলদের দুর্দশা শুরু হয়। শুধু পানি আর রোগব্যাধ্তিজ্বর ও আমাশয়ে অসংখ্য সৈন্য প্রাণ হারায়। বর্ষা শেষে হুমায়ুন আগ্রায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলে আফগানরা আক্রমণ করে এবং সৈন্য বাহিনীকে গঙ্গার দিকে ধাওয়া করে পিছু হটিয়ে দেওয়া হয়। সম্রাট হুমায়ূন আগ্রার দিকে পালিয়ে যান। কিন্তু দুর্বল অবস্থায় সেনাবাহিনী ছাড়াই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় তিনি পরাজিত হন। হুমায়ূন ও তার ভাইদের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলের আধিপত্য বণ্টন করে দেওয়া ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম কৌশলের অংশ। যেমন- সম্রাট হুমায়ূন সিংহাসনে বসার পর তিনি ভাইদের মধ্যে বিভক্ত অঞ্চলগুলো তার কাছাকাছি রাখেন।
এমনকি হুমায়ূনের সৎ ভাই কামরান মির্জা তার ভাই আসকারি মির্জাকে কান্দাহার এলাকা ছেড়ে দিয়ে লাহোরের দখল নেন। কাবুল, কান্দাহার এবং পাঞ্জাব কামরান মির্জার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ভাইদের মধ্যে আস্থা বিশ্বাসের অভাব ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে একেক এলাকার নিয়ন্ত্রণের রাখার এই কৌশল বেশিদিন কাজে লাগেনি। ইতিহাসবিদ সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় তার একটি গবেষণায় লিখেছেন, কনৌজের (বর্তমান উত্তর প্রদেশ) যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আগ্রা বা দিলিস্নতে হুমায়ূন বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে তিনি আহত ও রুগ্ন হাতিতে চড়ে লাহোর পৌঁছান। সেখানে তিনি প্রতিপক্ষের মুখোমুখিও হয়েছিলেন কেবল কামরান মির্জার কারণে। শের খান ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করার পর হিন্দাল মির্জাসহ চার ভাই লাহোরে জড়ো হন। শের খান যখন ১১২ মাইল দূরত্বের সিরহিন্দে পৌঁছান, তখন সম্রাট হুমায়ূন তার কাছে একটি চিঠি পাঠান। যেই চিঠিতে তিনি জানান, আমি সমগ্র ভারত (অর্থাৎ পাঞ্জাবের পূর্বে গঙ্গা উপত্যকা অঞ্চল) তোমার কাছে রেখে এসেছি। এখন সিরহিন্দকেও আমাদের আয়ত্ত্বে আনতে দাও। এই চিঠির জবাবে শের খান লিখলেন, আমি তোমার জন্য কাবুল ছেড়ে এসেছি, তুমি সেখানে যাও। কিন্তু কাবুল মূলত ছিল হুমায়ূনের ভাই কামরান মির্জার দখলে, যা কখনোই কামরান মির্জা তার ভাই সম্রাট হুমায়ূনকে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। পরে কামরান মির্জা শের খানের কাছে যান। ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কামরান মির্জা শের খানকে তার সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
বিনিময়ে পাঞ্জাবের একটি বড় অংশ তাকে দিয়ে দেওয়ার আশ্বাসও দেন। কিন্তু শের খান কামরান মির্জার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, সেটি তার দরকার নেই। কিন্তু লাহোরে এটি ছড়িয়ে পড়ে যে, ভাই কামরান মির্জাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য হত্যা করতে চান হুমায়ূন। যদিও পরে এই কথা অস্বীকার করেন হুমায়ূন। ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের মতে, পিতা বাবরের শেষ কথা অনুযায়ী ভাইদের কোনো ক্ষতি করতে চাননি হুমায়ূন। যদিও তারা এই ধরনের শাস্তির যোগ্য ছিলেন। সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ইতিহাসের নানা গল্পে রাজাদের বিভিন্ন সময় অনেকটা কঠোর ও নৃশংস হতে দেখা গেছে। যদিও মাত্র ২২ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেছিলেন হুমায়ূন। কিন্তু যুদ্ধ জয়ের দক্ষতা কিংবা অভিজ্ঞ শাসকদের মতো প্রজ্ঞাবান ছিলেন না তিনি। সিংহাসনে বসার পরই নানা ধরনের সমস্যা জড়িয়ে পড়েন হুমায়ুন, যা তার শক্তি ও ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছিল। হুমায়ূন তার পিতার কাছ থেকে সিংহাসন লাভ করেন। ভাইদের সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দিয়েছিল।