খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা ইত্যাদি হলো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকের মৌলিক অধিকার। একটি দেশকে সঠিকভাবে উন্নত করতে চাইলে সবার আগে সেই দেশের জনগণের খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য ছাড়া মানুষ অচল। তাই এই খাদ্যের নিরাপত্তার জন্য সরকারকে সচেতন হতে হবে। দেশে 'খাদ্য নিরাপত্তা' একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে একটি জনগণের বছরে যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন তা দেশে মজুত থাকাকে বোঝায়। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বলয় এখনো পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে সরকার এ ব্যাপারে সচেষ্ট রয়েছে।
এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, দেশে প্রায় ৪ কোটি মানুষ পুষ্টিহীনতার শিকার। প্রায় ৪৪ শতাংশ নারী রক্ত স্বল্পতায় ভোগেন। দেশে প্রতি পাঁচজনে একজন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল দুর্গম এলাকার দলিত, আদিবাসী, বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শহরের নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে পুষ্টিহীনতা বেশি। এই চিত্র সুখকর নয়।
সঠিকভাবে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বলয় গড়ে ও অপচয় কমিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা বাঁচাতে চায় সরকার। একই সঙ্গে দেশ থেকে পুষ্টিহীনতাও দূর করতে চায়। এ ব্যাপারে সরকার আন্তরিক ও মনোযোগী। এ জন্য কৃষিকে বাণিজ্যিকী ও যান্ত্রিকীকরণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যে সব খাতে খাদ্যের অপচয় হয় সে সব খাতে সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে। খাদ্যের অপচয় কমাতে সরকার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহযোগিতা নিয়ে দৃঢ়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
অবাক ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে মোট খাদ্যের প্রায় ৩০ ভাগ বিভিন্নভাবে নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ধান, গম, ভুট্টা, আলুসহ বিভিন্ন ফসল ও বাংলাদেশে উৎপাদিত সব ফলমূল এবং খাদ্যপণ্য ফলানো থেকে শুরু করে ঘরে তোলা ও বাজারজাতকরণে প্রচুর অপচয় হয়। এ সব অপচয় রোধ করতে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পথ অবলম্বন করা হবে। এ ছাড়া খাদ্য সংগ্রহ, পরিবহণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার ধাপগুলোর আধুনিকায়নও করা হচ্ছে। এর ফলে খাদ্যপণ্যের অপচয় অনেকটা কমে আসবে।
উলেস্নখ্য, দেশে জিডিপির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আসে কৃষি খাত থেকে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি দেশের বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানও ঘটে কৃষিকে অবলম্বন করেই। ইউরোপ-আমেরিকায় শাকসবজির অনেক দাম। এ দেশের কৃষিপণ্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত দেশের বাজারে রপ্তানি করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
আশার কথা, বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ২০০৯ সালে সাড়ে ৩ কোটি থেকে ১০ বছরে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪ কোটি ১৩ লাখ টন। মাঠপর্যায়ে গবেষণা ও তদারকি বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাকে আরও শক্ত করার পাশাপাশি উৎপাদিত খাদ্য যেন নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্যের অপচয় রোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এটা স্বীকার করতেই হবে, ২০১০ সাল থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়লেও দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমছে। দারিদ্র্যর হার কমিয়ে আনতে সব দরিদ্র পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। সরকারের এ ধরনের নানামুখী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ অত্যন্ত ইতিবাচক। করোনাকালে সরকার দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, দেশের সব নাগরিকের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে দারিদ্র্য দূর হোক এটাই আমরা চাই। তবে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে না পারলে দারিদ্র্য পুরোপুরি দূর করা সম্ভব নয়। পরিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয় খাদ্য নিরাপত্তাও। বাধা ও সীমাবদ্ধতা দূর করতে পারলে দারিদ্র্য আশানুরূপ হ্রাস করা সম্ভব। সম্ভব পর্যায়ক্রমে মধ্যম আয়ের ও উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাও। তবে করোনার জন্য বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে তার প্রভাব যে বাংলাদেশে পড়বে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। সুতরাং আমাদের সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।