শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আপসহীন বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

আতিক হেলাল
  ১১ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপসহীন বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ
আপসহীন বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত আইনবিদ, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম 'সার্ক'-এর অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি নাম।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি কলকাতার এক সন্ত্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। বিচারপতি মোরশেদ একজন আইনবিদ ও বিচারপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন যথার্থ সংস্কতিবান ব্যক্তিত্ব, যিনি বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত থেকে সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন।

1

আমরা জানি, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় আইন পেশায় বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ঘটে অনেক বিলম্বে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্যে শিক্ষিত মুসলমান আইনজীবীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। অথচ স্বাধীন পেশা হিসেবে তখনো সমাজে আইন পেশার গুরুত্ব ছিল অসামান্য। বিশেষ করে ওপনিবেশিক আমলে তারা রাজনৈতিক ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিতে পারতেন অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি।

সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের পূর্বপুরুষ স্যার সৈয়দ আমীর আলী (৬ এপ্রিল ১৮৪৯-৩ আগস্ট ১৯২৮) কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলমান বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৮৯০ সালে। এরপর তার পুত্র সৈয়দ তারেক আমীর আলীসহ আরও অনেক বাঙালি মুসলমান হাইকোর্টের বিচারপতি হন। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তৎকালীন হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে তার এই সম্মানজনক আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধদ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে। তবে বিচারপতিরা কর্মজীবনে সবাই সমান খ্যাতি অর্জন করেননি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তাদের সবার অংশগ্রহণ সমান সপ্রতিভ নয়। এক্ষেত্রে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন সত্যিই এক অনন্য ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন তার কর্মক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তার কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক প্রসারিত। তাই তো একপর্যায়ে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হতে দ্বিধা বোধ করেননি। বিচারপতি-জীবনে তিনি অনেকগুলো জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার এতিহাসিক, সময়োপযোগী রায় দিয়ে স্বৈরশাসনের মধ্যেও আইনের শাসন সমুন্নত রাখেন।

বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও আরবি-ফারসি ভাষায় তার দখল ও পান্ডিত্য ছিল। আইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিষয়ে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অখন্ড পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি আসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন। নির্ভেজাল গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি ছিলেন একজন অবিচল প্রবক্তা। সর্বোপরি, তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বৈদগ্ধ সব প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও উজ্জ্বলতাকেও অতিক্রম করেছে।

জন্ম ও পরিবার : পারিবারিক সূত্রমতে, হযরত ইমাম হোসেনের বংশধরদের একজন, মুফতি সৈয়দ আলী রাশেদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের প্রথম দিকে সদর দেওয়ানি আদালতের বিচারক ছিলেন। তিনি তাদের পূর্বপুরুষদের একজন বলে জানা যায়। মাহবুব মোরশেদের পিতা সৈয়দ আবদুস সালেকও একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তিনি যোগ দেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালের হিসাবে তিনি বগুড়া, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় নিযুক্ত ছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তার বেশ খ্যাতি ছিল। মাহবুব মোরশেদের মা আফজালুরেসা বেগম ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। মাতামহ কাজীওয়াজেদ আল ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান আইন গ্র্যাজুয়েট প্রখ্যাত সমাজ-সংক্ষারক নবাব আবদুল লতিফের জ্ঞাতি ভাই। পিতা ও মাতা-উভয় দিক থেকেই মোরশেদ ছিলেন এতিহ্যসম্পন্ন পরিবারের উত্তরাধিকারী। ১৯৩৯ সালের ১ অক্টোবর কলকাতার মেয়র এ কে এম জাকারিয়ার কন্যা লায়লা আরজুমান্দ বানুর সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন মাহবুব মোরশেদ। তাদের ৪ সন্তানের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ কন্যা সাঈদা মোরশেদ।

দ্বিতীয় সন্তান (জ্যেষ্ঠ পুত্র) সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন সচিব ও বিটিআরসির চেয়ারম্যানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ৩য় পুত্র সৈয়দ মামনুন মোরশেদ লন্ডন কলেজ অব মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যক্ষ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সৈয়দ মানসুর মোরশেদ বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির পো-ভাইস চ্যান্সেলর পদে কর্মরত আছেন।

শিক্ষা : মাহবুব মোরশেদ একজন কৃতী ছাত্র ছিলেন। স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিতে তিনি প্রথম হয়েছেন। ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে তিনি সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন। প্রবেশিকা পাসের পর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই তিনি ১৯৩১ সালে অর্থনীতিতে সম্মানসহ সাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং প্রথম শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি নেন যথাক্রমে ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে। মেধাবী ছাত্র মাহবুব মোরশেদ ছাত্রজীবনেই বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যেও বিখ্যাত লেখকদের উলেস্নখযোগ্য বইগুলোও পড়া শেষ করেন। কলেজ জীবনে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায়ও সমপৃক্ত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ-ম্যাগাজিনের তিনি সম্পাদকও ছিলেন একবার। একই সময়ে তিনি তুখোর বক্তা হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। কলেজজীবনে তিনি ক্রীড়াক্ষেত্রেও সুনাম অর্জন করেন। ৩০-এর দশকে মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের সংগঠকের দায়িত্বও পালন করেন। সেকালে মুসলমান তরুণদের মধ্যে খেলাধুলায় অংশগ্রহণে এক ধরনের অনীহা ও অবহেলা ছিল, তরুণ মাহবুব মোরশেদ নেই নেতিবাচক অবস্থা দূরীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

আইন পেশায়: মাহবুব মোরশেদ কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেনে ১৯৩৪ সালে। তবে তিনি মামা ফজলুল হকের সহকারী না হয়ে সুভাষ চন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) এবং খ্যাতনামা অবাঙালি আইনজীবী কে বি খাইতানের জুনিয়র হয়ে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু এর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আইনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্য যান। ১৯৩৮ সালে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত লিংকন'স ইন থেকে বার অ্যাট ল' (ব্যারিস্টার) ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি আবার আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বার-এ যোগ দেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বারে প্র্যাকটিস করেন। এ সময়টি ছিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। ভাষা আন্দোলন, ৫৪'র নির্বাচন, যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা এবং শেরে বাংলার নেতৃত্বে গঠিত সেই সরকারের কেন্দ্র কর্তৃক বরখাস্ত হওয়া, রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নানামুখী নির্যাতন ইত্যাদি ঘটনায় সময়টা ছিল উত্তাল। এসব ঘটনা নিয়ে তিনিও সচেতন ছিলেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলেনে নিজেকে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন।

বিচারপতি : ১৯৫৫ সালে, যখন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী, তখন সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধান সংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে যারা সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেন, মাহবুব মোরশেদ ছিলেন তাদেরই একজন।

দেশে তখন হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট সরকার। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এ সময়ে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকও কিছুদিন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন আইনের শাসনের অবিচল প্রবক্তা। ১৯৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। মানুষের সব মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তখন দেশের উচ্চ আদালতের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতরও বটে। তখন বিচারপতির আসনে থেকে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা ছিল তৎকালীন প্রতাপশালী সরকারের বিরুদ্ধে। মরহুম বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর মতে, বিচারক মোরশেদের অনেকগুলো রায় ছিল ইতিহাসের মাইলফলক, দেশের সাংবিধানিক আইনের ম্যানাকার্টা স্বরূপ। একবার (১৯৬৪) পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। বিচারপতি মোরশেদ হাইকোর্ট থেকে সুয়োমোটো (স্বঃপ্রণোদিত রুল) জারি করলেন, যার ফলে এ দেশের সংখ্যালঘুদের কোনো আঘাত আসতে পারেনি? বিচারপতি মোরশেদ কিছুকাল পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টেরও (আপলি বিভাগ) এডহক বিচারক ছিলেন। সেখানেও তিনি তার কৃতিতেও স্বাক্ষর রাখেন। এর আগে, ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল ফেমিন এবং ৪৬-এর দাঙ্গার সময়ে তিনি আন্তুমান মুফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত থেকে অনেক মানবিক ও সমাজসেবামূলক কাজেও অংশ নিয়েছেন। '৪৭-এর দেশভাগের পর নেহরু-লিয়াকত চুক্তিতেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশের ভাষা সংগ্রামেও বিচারপতি মোরশেদ সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফ্রেব্রম্নয়ারি ভাষা শহীদদের লাশের জানাজা শেষ করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বিচারপতি মোরশেদসহ অন্য সহযোদ্ধারা বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানের দিকে অগ্রসর হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের সামনে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। পুলিশের বাধা ও হামলা সত্ত্বেও তারা মিছিল নিয়ে অগ্রসর হলে একপর্যায়ে শেরে বাংলা ও তার ভাগ্নে বিচারপতি মোরশেদকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়? তবে কয়েক ঘণ্টা পরেই তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। বিচারপতি মোরশেদ প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়ই প্রচুর সাহসিকতা ও গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৬৬-তে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যে ৬ দফার কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাবরণ করতে হয়। শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই বিচারপতি মোরশেদ ৬ দফা প্রণয়নে সম্পৃক্ত হননি, '৬৫-এর যুদ্ধের পরে তিনি উপলব্ধি করেন যে, পূর্ববাংলার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও যথেষ্ট মজবুত ছিল না। এই বিষয়টিও গভীরভাবে তীর চিন্তার মধ্যে ছিল। ১৯৬৯-এ আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মোরশেদ ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট দাবি করেছিলেন। তীর যুক্তি ছিল, ওয়ান ইউনিট পাকিস্তান ভেঙে দেওয়ার পরে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ববাংলা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এই অঞ্চলের ভোটেই পাকিস্তান গঠিত হয়। যে কারণে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন পূর্ব বাংলার প্রাপ্য। সেই হিসাবে এই অঞ্চলে যে দল বেশি আসন পাবে, সেই দলই কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের দাবিদার।

জানা যায়, ১৯৭১-এর ৮ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের একদল আইনজীবী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানের শপথ গ্রহণের বিষয়ে বিচারপতি মোরশেদের কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে তখন বলেছিলেন, এই মুহূর্তে দেশে একটা সাংবিধানিক ভ্যাকুয়াম চলছে, এই পরিস্থিতিতে টিক্কা খানের শপথ গ্রহণ সমীচীন নয়।

আর একটি ঘটনার কথা বলতে হয়। ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি মোরশেদ তাকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক ফোরাম গঠনের জন্য পরামর্শ দেন এবং দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় বিচারপতি মোরশেদের এক স্মরণ সভায় তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন এই তথ্য উলেস্নখ করেন।

সর্বোপরি বিচারপতি মোরশেদ একজন প্রগতিশীল ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। তবে তিনি কখনো কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলাননি। তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সাহসের সঙ্গে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আন্দোলেনে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন অন্যতম প্রধান রূপকার, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও বিচারপতি মোরশেদের মতো সাহসী, দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্বের বড্ড অভাব অনুভূত হয়।

আতিক হেলাল : কবি, শিশু-সাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে