শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়ন ও রাজনীতি

জিয়াউল হক
  ১১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

'বাঙালির ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙালি বাঁচিবে না' শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৮০ সালের বঙ্গদর্শন পত্রিকায় উক্তিটি করেছিলেন। উক্তিটি তিনি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে করলেও তা বর্তমান বাস্তবতায় রয়েছে এর সুদূরপ্রসারি প্রভাব। কবি গুরু বলেছেন 'হে অতীত! তুমি ভুবনে ভুবনে, কাজ করে যাও গোপনে, গোপনে'। কোনো জাতি যদি তার অতীত ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা না রাখে তাহলে সে জাতি রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক মানদন্ডে বিশ্ব দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। ইতিহাস হলো অতীত থেকে গৃহীত শিক্ষা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা। যে যত অতীত গভীরতায় যেতে পারবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সে ততদূর এগুতে পারবে। মানুষ একমাত্র প্রাণী যে ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে পারে। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার নবীনতম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের এবং বাঙালি জাতির রয়েছে এক গৌরবময় অতীত ইতিহাস। ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলা দখলের মাধ্যমে ভারতবর্ষ দখল করে। অবশ্য ইংরেজরা এদেশ দখল না করলেও ফরাসিরা দখল করত। দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের পর ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন আইন প্রবর্তন করে। সে আইনের অধীন প্রথম ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক নির্বাচন হয় এবং উপমহাদেশে দলীয় রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। ব্রিটিশ ভারতে যে রাজনৈতিক দলগুলো ছিল প্রকৃতপক্ষে সেগুলো কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। রাজনৈতিক দল বলতে আমরা যা বুঝি যেমন-তাদের নিজস্ব আদর্শ, মেনিফেস্টো থাকবে, নির্বাচিত হলে শাসনতন্ত্র কেমন হবে, দেশ কিভাবে চালাবে ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকবে। কিন্তু একটি পরাধীন দেশে অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতে সে রকম কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। যেগুলো ছিল তারা মূলত ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করে বিভিন্ন দাবি আদায় করত যেমনটা করে থাকে আমাদের দেশের অফিস-আদালতের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনসমূহ। তারপরও বলতে হয় ১৯৩৭ সালের পর থেকে নির্বাচিত মন্ত্রিসভার মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক উন্নতি ঘটে এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হয়। নির্বাচিত নেতাদের বিরুদ্ধে সাধারণ একটা অভিযোগ হলো নির্বাচনের আগে যে প্রতিশ্রম্নতি দেয়, নির্বাচন হওয়ার পর তা ভুলে যায়। ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশ হওয়ার পরও এ কথা সত্য। এমপি কেনাবেচা, মন্ত্রিসভার পতন ইত্যাদি রাজনৈতিক ঘটনা আমাদের ইতিহাসে রয়েছে। ১৯৩৭ সালের হক মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে '৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা পর্যন্ত কোনো মন্ত্রিসভা পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি।

বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। তার আগে ১৯৭০ সালে হয় পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনে অবতীর্ণ হন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন দখল করে। দুটি আসন অর্থাৎ পিডিবি নেতা নূরুল আমিন এবং রাজা ত্রিদেবের আসন দুটি বাদে। বয়সে তরুণ হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং দূরদর্শিতা, যা আমরা পরে দেখতে পাই। নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব আসনই জয়ী হয়। নির্বাচনের পর তিনি যে ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা করলেন, তা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার শিক্ষা থেকেই করলেন। ৩ জানুয়ারি ১৯৭১ তিনি রেসকোর্স ময়দানে প্রায় বিশ লাখ লোকের বিশাল সমাবেশে নির্বাচিত সদস্যদের দিয়ে শপথ করালেন এবং নিজেও শপথ করলেন এই মর্মে- 'ছয় দফা ওয়াদা খেলাপ করিব না'। সব নির্বাচিত সদস্যই সে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন এবং অঙ্গীকার করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল প্রখর। তিনি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারতেন। তিনি কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। নির্বাচিতদের মধ্যে কেউ সুযোগ-সুবিধা পেলে দলত্যাগ করবে না এটা হলফ করে বলা যায় না। তাছাড়া পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী শুধু দীর্ঘদিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল না, তাদের অর্থবিত্ত, ধনসম্পদ, প্রতিপত্তির অভাব ছিল না। অর্থের লোভ দেখিয়ে নির্বাচিতদের একদলকে হাত করে আওয়ামী লীগের মেজরিটি নিষ্ক্রীয় করা মোটেও অসম্ভব ছিল না। রেসকোর্স ময়দানের শপথের ফলে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিতরাও সাবধান হয়েছিল এবং পশ্চিমা নেতাদেরও আওয়ামী লীগ ভাঙার আশা ভঙ্গ হলো। এমনকি ১৯৭২ সালের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের ডিগবাজির সুযোগ রদ করা হয়, যা আজ পর্যন্ত বহাল রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আর একটি রাজনৈতিক দূরদর্শিত হলো দল গঠনে এবং উত্তরসূরি নির্বাচন করতে ময়মনসিংহ থেকে এনেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামকে, গাজীপুর থেকে তাজউদ্দীন আহমদকে, রাজশাহী থেকে এএইচএম কামারুজ্জামানকে এবং সিরাজগঞ্জ থেকে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে। এরা সবাই জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই জাতীয় চার নেতা যতদিন বেঁচেছিলেন দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং একই ভাগ্যবরণ করেছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদত বরণ করেন। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নৌকার হাল ধরেন। সেই থেকে আজঅবধি তিনি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারও রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার কৌশল, দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে আত্মত্যাগ, যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় দায়িত্ব দেওয়ার মতো ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে তিনি আমাদের উপমহাদেশে সমসাময়িক নেতাদের মধ্যে অদ্বিতীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এক দশক ধরে যে উন্নয়ন করে যাচ্ছেন তা অভাবনীয়। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এখন বাস্তবতা, স্বপ্ন নয়।

যোগ্য লোক নির্বাচনেও প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে বিচক্ষণ দর্শনশক্তি। ২০১৫ সালে তার একান্ত সচিব-১ করেছিলেন অতিরিক্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসানকে। সাজ্জাদুল হাসানের জন্ম নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে। সাবেক গণপরিষদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম ডা. আখলাকুল হুসাইন আহমেদের দ্বিতীয় পুত্র সাজ্জাদুল হাসান। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ বারহাট্টা আসন থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন মরহুম আব্দুল মমিন (পরে মন্ত্রী) এবং প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন মরহুম ডাক্তার আখলাকুল হুসাইন আহমেদ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ডাক্তার আখলাকুল হুসাইন আহমেদ ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেষখোলা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। আব্দুল মমিন (সাবেক খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী) এবং ডাক্তার আখলাকুল হুসাইন আহমেদের নির্বাচনী আসন একই হওয়ায় বঙ্গবন্ধু ডাক্তার আখলাকুল হুসাইন আহমেদকে ডেকে বলেছিলেন 'আব্দুল মমিন তোমার চেয়ে নেতা হিসেবে সিনিয়র। এ পর্যায়ে তাকে মনোনয়ন দিতে চাই। ভবিষ্যতে তোমার ব্যাপারে চিন্তা করব। তুমি কিছু মনে কর না।' পরে তিনি আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেননি, বাকি জীবন নিজেকে সমাজের সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন।

ডাক্তার প্রয়াত আখলাকুল হুসাইন আহমেদের সুযোগ্য সন্তান সাজ্জাদুল হাসান যিনি বাবার মতো সারাজীবন মানুষের সেবায় ব্রত। তিনি ১৯৮৮ সালে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে কর্মজীবন শুরু করেন। মাঠ প্রশাসনে কক্সবাজার এবং সিলেট জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে সিলেট জেলার বিভাগীয় কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব-১ হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব এবং ২০১৯ সালে সিনিয়র সচিব হন। অবসরের পর তাকে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২৭ জানুয়ারি ২০২০-এ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ বিমানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়।

সাজ্জাদুল হাসান ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদ গ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। রাজনীতিতে তার আবির্ভাবে নেত্রকোনার মতো একটি প্রত্যন্ত হাওড় জনপদের সাধারণ মানুষ অতিশয় আনন্দিত। কারণ তিনি প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ এবং সিনিয়র সচিব থাকাকালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এবং সহযোগিতায় এলাকার যে উন্নয়ন করেছেন, তিনি রাজনীতিতে আসলে উন্নয়নের ধারা আরও বেগবান হবে।

জিয়াউল হক : সহকারী মহাব্যবস্থাপক, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে