শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথা ভাঙার হাতিয়ার

নতুনধারা
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মানুষের সমাজ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই যাবতীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, ধর্মীয় রীতিনীতির উদ্ভব। কালক্রমে ধর্ম এখন সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। ফলে যে সমাজের ধর্মীয় রীতিনীতি, সংস্কৃতি যতবেশি উদার সে সমাজ ও সংস্কৃতি তত বেশি আধুনিক। সে সমাজের চিন্তাচেতনা, রাজনীতি, অর্থনীতি তত বেশি মজবুত; নান্দনিক ও বেগবান। মানুষের যাবতীয় কর্মকান্ডের মতো ধর্মীয় রীতিনীতিরও একমাত্র লক্ষ্য মানুষের মুক্তি। দুঃখজনক সত্য হলো- কালক্রমে প্রায় প্রতিটি ধর্মই হয়ে উঠেছে অপব্যাখ্যা এবং কুসংস্কারের আধার। যুগযুগ ধরে একটি মহল ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, কুসংস্কারকে ব্যবহার করছে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে। ধর্মীয় উস্কানিকে কেন্দ্র করে একই দেশে গড়ে উঠছে জাতিবিদ্বেষী নানান মত ও পথ। বিঘ্নিত হচ্ছে রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।

আজ আমরা যে উদার, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও শিল্পমনা ইউরোপ আমেরিকা দেখতে পাচ্ছি এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ শিল্পবিপস্নব নয়, বরং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, খ্রিষ্টধর্মের সময়োপযোগী সংস্কার।

আজ থেকে ৫০০ বছর আগের ইউরোপ কতটা নৃশংস অমানবিক ও পশ্চাৎপদ ছিল আমরা তা এখন কল্পনাও করতে পারি না। শুধুমাত্র ১৬ শতকেই কয়েক লাখ নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল খ্রিষ্টধর্মের দোহাই দিয়ে। ওইসব নারীদের অপরাধ ছিল ওরা চাকরি করতে চাইত, বিশ্বাস করত ব্যক্তি স্বাধীনতায়। ওইসব নারীদের অপবাদ দেওয়া হয়েছিল লিলিথ ডাইনি বলে। এরকম অসংখ্য অমানবিক ঘটনা আজও মানবসমাজের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ, কী এক ভয়াবহ ধর্মীয় উন্মাদনা এবং কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল আজকের আধুনিক ইউরোপ! যেখানে বিজ্ঞানের কথা বলার অপরাধে গ্যালিলিও এর মতো বিজ্ঞানীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল ব্রম্ননো, স্পিনোজা, হাইপেশিয়ার মতো বিজ্ঞানমনস্ক, মানবতাবাদী মানুষের। সেই ইউরোপ আমেরিকার দিকে তাকালে আজ বিস্মিত না হয়ে পারি না। আশ্চর্য হতে হয় ওদের বিজ্ঞানমনস্কতা, নারী পুরুষের সমান অধিকার, শিল্প সাহিত্যচর্চা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি দেখে।

এবার দেখা যাক একবিংশ শতাব্দীতে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশের আশিভাগ মানুষ যেহেতু ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী এবং দ্বিতীয় বড় অংশটি যেহেতু সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী তাই আসুন আমরা আমাদের প্রেক্ষাপটেই বাস্তবতা নিরীক্ষণ করি-

১. ঘটনাটি সম্ভবত আজ থেকে বিশ বছর আগের। কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামুইনের একটি গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তেরো কিংবা চৌদ্দ বছরের একটি মেয়েকে দাফন করা হচ্ছিল। উপস্থিত লোকদের কথাবার্তায় জানতে পারলাম মেয়েটি প্রেগন্যান্ট ছিল এবং বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছে। উপস্থিত দু'একজন বলাবলি করছিল মেয়েটি যেহেতু ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়নি এবং স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় মৃতু্যবরণ করেছে এসব হিসেবে মেয়েটি অবশ্যই বেহেস্তে যাবে!

২. কিছুদিন আগের ঘটনা, আমার এক বন্ধুর স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। বন্ধুটি বলছিল কিছুতেই সে হাসপাতালে যাবে না। সিজার করাবে না। তার স্ত্রী ব্যথায় চিৎকার করে মরে গেলেও এমন গর্হিত কাজ সে করবে না। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ডাক্তারের কাছে যাওয়া, সিজার করানো নাকি ধর্মবিরোধিতা!

যাই হোক, এমন দু-একটি ব্যতিক্রম ঘটনা বাদ দিলে সামাজিক চিন্তাচেতনায় আমরা এখন বিগত কয়েক দশকের তুলনায় অনেক দূর এগিয়েছি। আমাদের এখনো আশার জায়গা আছে। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে নারী নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহের মতো কুপ্রথাকে ভাঙতে শুরু করেছি। শতবছর আগেই বন্ধ হয়েছে সতীদাহের মতো নিষ্ঠুর প্রথা। হিন্দু মুসলিম উভয় পরিবারের মেয়েরা এখন অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে পারে। স্কুলে যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, কর্মক্ষেত্রেও যেতে পারে। আমাদের মেয়েরা আফগানিস্তানের মেয়েদের মতো এখনো বন্দি হয়ে যায়নি। স্কুলে যাওয়ার অপরাধে মালালার মতো গুলিবিদ্ধ হচ্ছে না। ইরানি মেয়েদের মতো হিজাব না পরার অপরাধে শরিয়া আইনের রোষানলে পাখির মতো প্রাণ দিচ্ছে না।

তবে হতাশা এবং শঙ্কারও যথেষ্ট কারণ আছে। এই বাস্তবতা শহর এবং গ্রামে একইরকম নয়। এখনো অনেক মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে, চাকরি করতে হলে ঘরে-বাইরে লড়াই করতে হয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, আমাদের গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা প্রাতিষ্ঠানিক ড্রেস পরে না। রঙবেরঙের বোরকা এবং হিজাব পরে কলেজে যায়। মেয়েদের এটা করতে পরিবার থেকেই বাধ্য করা হয়। অনেক কট্টরপন্থি শিক্ষক-শিক্ষিকাও মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে এমনটা করতে বাধ্য করে। তাই রাজনৈতিক পালাবদলের চেয়ে বেশি প্রয়োজন আজ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। কারণ শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, কবি, শিল্পী, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধার সবাই উঠে আসে সমাজ কাঠামো থেকেই।

ভেবে পাই না, যে মেয়েগুলো স্কুল-কলেজে মুখের আবরণ খুলতে লজ্জা পায়, সংকোচবোধ করে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণকে পাপ বলে বিশ্বাস করে ভবিষ্যৎ জীবনে কেমন করে ওরা সাবলীলভাবে অফিস আদালত করবে? রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে? পুরুষের সমান শক্তি সামর্থ্য নিয়ে বাস্তবজীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে? কোরআনে, পুরাণে, আইনে সুস্পষ্ট উলেস্নখ থাকা সত্ত্বেও (বি.দ্র. বাংলাদেশের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধন সময়ের দাবি) ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে অধিকাংশ নারীকে এখনো বঞ্চিত করা হচ্ছে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে। তথাকথিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির দরুন এখনো আমাদের মেয়েরা বাবার লাশ কাঁধে নিয়ে কবরে কিংবা চিতাশালে যেতে পারে না।

শুধু নারীর স্বাধীনতা, নারীর অধিকার হরণের জন্য নয়; ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, কুসংস্কারকে প্রতিমুহূর্তে দাঁড় করানো হচ্ছে বিজ্ঞান মনস্কতা, শিল্প, সাহিত্য, যে কোনো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির চরম প্রতিপক্ষ হিসেবে। যা সমাজ, রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টের প্রধান কারণ। হাজার বছরের যাপিতজীবনের ফসল উদার ও ভাতৃত্ব পূর্ণ উৎসবমুখর বাঙালি সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি আরব্য নয়, হিন্দুয়ানি নয়, ইউরোপিয়ান নয়। অথচ বহুকাল ধরে আমাদের সব সাংস্কৃতিক আনন্দ উৎসবের টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা চলছে অতি সুকৌশলে। কখনো বলা হচ্ছে এই সংস্কৃতি মুর্খদের, এসব হিন্দুয়ানি, কখনো বলা হচ্ছে এসব বিধর্মীদের, বিজাতীয়!

আমরা '৪৭ থেকে শিক্ষা অর্জন করতে পারিনি, শিক্ষা অর্জন করতে পারিনি একাত্তরের ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি থেকে। এখনো কি সময় হয়নি এসব ধর্মীয় অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যাকে যারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ওদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার?

বলা হয় মহা মানবরা এসেছিলেন সব কুসংস্কার এবং অন্ধকার দূর করতে। তারা এসেছিলেন মানুষের মুক্তি এবং ঐক্যের লক্ষ্যে। যদি তাই সত্যি হয়, তবে আমাদেরও অনুসরণ করতে হবে সেই সহজ, সরল, মানবিক পথ। শুধু ইসলাম কিংবা সনাতন ধর্ম নয়, বরং সব ধর্মকেই আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করে গ্রহণ করতে হবে প্রথা ভাঙার হাতিয়ার হিসেবে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে সোচ্চার এবং সাহসী হতে হবে কবিসাহিত্যিক, উদার ধর্ম তাত্ত্বিক এবং সংস্কৃতিকর্মীদের। ওদের দেখানো পথকে বাস্তবে রূপ দিতে এগিয়ে আসতে হবে রাজনীতিবিদদের। তবেই গড়ে উঠবে সত্যিকারের উন্নত এক বাংলাদেশ। আর না হলে সবই টালবাহানা, রাজনৈতিক পালাবদলের খেলা। সামনে জাতীয় নির্বাচন। সবার আগে জনগণকে চিনে নিতে হবে কারা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির শত্রম্ন-মিত্র। কারা চায় গণমানুষের মুক্তি, বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়ন।

আজিজুল রমিজ

লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

তারাপাশা বয়লা, কিশোরগঞ্জ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে