বাংলাদেশে গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক দশকে বায়ুদূষণ মৃতু্যর জন্য একটি অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে অকালে মৃতু্যর শতকরা ৮৯ ভাগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু বা বাতাস। যা দূষিত হয়ে যায় খুব সহজেই এবং দূষিত বায়ু ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। পুরো বিশ্বে ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষণযুক্ত বায়ুতে শ্বাস নেয়। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের মৃতু্যর কারণ বায়ুদূষণ। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জন মৃতু্যবরণ করেছেন, যা ২০১৭ সালের তুলনায় প্রায় ৫০ হাজার বেশি। বিশ্বে ২০২২ সালে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর তালিকায় বাংলাদেশের নাম পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার পাশাপাশি অবনতি হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যেরও। বাড়ছে অবসাদ ও উদ্বেগ। মূলত বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ণ বস্তুকণা পিএম-২.৫-এর পরিমাণ কতটুকু, তা পর্যালোচনা করে বায়ুর মান সূচকটি তৈরি করা হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, বায়ুতে প্রতি ঘনমিটারে পিএম-২.৫ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি সর্বোচ্চ ৫ মাইক্রোগ্রাম হতে হবে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী ১০ জনের মধ্যে ১ জন এমন এলাকায় বসবাস করছে, যেখানে বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করছে। একই সময়ে মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল গুয়ামের বায়ু বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় পরিষ্কার। সেখানকার বায়ুতে পিএম-২.৫-এর উপস্থিতি ১ দশমিক ৩ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্বের রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার বায়ু ক্যানবেরার। সেখানকার বায়ুতে পিএম-২.৫-এর উপস্থিতি ২ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে রাজধানী ঢাকা ও তার বেশ কিছু শিল্প-কলকারখানাভিত্তিক অঞ্চল এবং মানবসৃষ্ট কারণগুলো বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। ময়লা, ধুলোবালি, কালি বা ধোঁয়া, বিদু্যৎ উৎপাদন কেন্দ্র, নির্মাণাধীন ভবন বা স্থাপনা থেকে তৈরি হওয়া বায়ুদূষণ আমাদের জনজীবনকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাড়ছে শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ জটিল রোগ ও মানসিক সমস্যা। পরিবেশগত কারণে ও গৃহস্থালি সংক্রান্ত কারণে সৃষ্ট বায়ুদূষণের সম্মিলিত প্রভাব প্রতি বছর ৬৭ মিলিয়ন অকাল মৃতু্যর সঙ্গে জড়িত। জ্বালানি থেকে অতিরিক্ত নির্গত নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের প্রভাব পড়ছে পরিবেশে। এসব বিষাক্ত গ্যাসের কণা আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা স্তর ভেদ করে ঢুকে যায় খুব সহজেই। এসব কারণে হতে পারে মরণব্যাধি ক্যানসার, হাঁপানি এবং স্ট্রোক (মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ)। বিশেষত শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী বায়ুদূষণে বেশি আক্রান্ত হন। পাশাপাশি যানবাহন থেকে নির্গত বায়ুদূষক যেমন কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড বায়ুদূষণের প্রধান কারণ। দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশে চলতে থাকা বায়ুদূষণ প্রভাব ফেলে মানসিকতার নানা সমস্যায়। যেখানে নারীর তুলনায় পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে বেশি। যুক্তরাজ্যের প্রায় চার লাখ মানুষের ওপর চালানো এক জরিপে এমনটাই জেনেছেন গবেষকরা। বায়ুমন্ডলে এই বায়ুদূষণের ক্রমবর্ধমান বিষাক্ত গ্যাসের কারণে বাড়তে পারে অবসাদ ও মানসিক উদ্বেগ বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা। বাংলাদেশের মতো প্রগতিশীল রাষ্ট্রে বায়ুদূষণের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যেরও যে প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে যথেষ্ট কারণগুলো খতিয়ে দেখা হয় না, নেওয়া হয় না সুষ্ঠ উদ্যেগ। যেখানে সম্প্রতি চীনের মতো দেশগুলোতে বায়ুদূষণ ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে তা প্রকাশ করেছে। কিছু সূক্ষ্ণ কণা যা বায়ুদূষণ ঘটায় কিছু স্বাভাবিক মানসিক সমস্যা যেমন- হতাশা, উদ্বেগ এবং কর্মহীনতার সঙ্গে জড়িত। তবে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব এখনো খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না বা এ ব্যাপারে আরও অধিকতর গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেসব মানসিক রোগ বায়ুদূষণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তার মধ্যে রয়েছে ডিমেনশিয়া, অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, ডিপ্রেশন/বিষণ্নতা ইত্যাদি। বাতাসে বেনজিন ও কার্বণ মনো অক্সাইডের উপস্থিতি সিজোফ্রেনিয়া রোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অত্যাধিক বায়ুদূষণের ফলে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্নায়ুতন্ত্রের স্নায়ুর কাজ ব্যাহত হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্নায়ুর মৃতু্যও হতে পারে। কোরিয়ান একটি গবেষণাপত্রে বাতাসে নাইট্রিক অক্সাইডের অত্যাধিক মাত্রায় উপস্থিতি ডিপ্রেশনে/বিষণ্নতায় ভোগা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত দেখা গেছে। সাউথ কোরিয়ার এক গবেষণায় আত্মহত্যার প্রবণতার সঙ্গে বাতাসে সালফার ডাইঅক্সাইড ও ওজোনের মাত্রার সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন কয়েক লাখ যানবাহন চলাচল করে। যেখানে সাধারণ ইঞ্জিনের সঙ্গে বিকট শব্দের পাশাপাশি নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণকে বাড়িয়ে তুলছে। গবেষণায় দেখা যায় সিএনজিচালিত যানে এ দূষণ কম হয়। তাই সিএনজিচালিত যানবাহনের বৃদ্ধি করা যেতে পারে। কল-কারখানার ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে ধোঁয়া নির্গমন নল ও চিমনি থেকে বস্তুকণা পৃথক করার জন্য ছাকনি বা অন্য কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। পরিবেশের বায়ুস্তর সংরক্ষণে প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ হ্রাস করে সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিভিন্ন পরিত্যক্ত বর্জ্য না পুড়িয়ে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা যায়। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প উপায়ে শস্যের রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি হাটবাজার, বসতবাড়ি থেকে পচনশীল দ্রব্য দ্রম্নত অপসারণ করতে হবে। শহরাঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে রাখা ডাস্টবিনের ময়লা দ্রম্নত শোধনাগারে পাঠাতে হবে। নগরায়ণের উন্নয়নে নগরের বসতি, শিল্প-কারখানা পরিকল্পিতভাবে স্থাপন করতে হবে। সর্বোপরি বৃক্ষরোপণ ব্যবস্থার গতানুগতিক প্রক্রিয়া প্রবহমান রাখতে হবে। কারণ উদ্ভিদ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে এবং উদ্ভিদ অক্সিজেন ত্যাগ করে ও কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে ভারসাম্য বজায় রাখে। ফলে এভাবে বায়ুদূষণ নিরসনে সুস্থ পরিবেশ মোতায়েনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নির্বিঘ্নে সতেজতা বজায় রাখা সহজতর হয়ে উঠবে।