বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী আমাদের এই দেশ গণতান্ত্রিত দেশ, জনগণ হবে সব ক্ষমতার উৎস। গণতন্ত্র বলতে কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের এমন একটি শাসন ব্যবস্থাকে বোঝায়- যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সব নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে- যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র শব্দটি বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাঁড়ায় 'জনগণের ব্যবস্থা'। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অনেকে অনেকভাবে দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো- খ্রিষ্টপূর্ব ৪২২ সালে ক্লিয়ান ডেমোক্রেসিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- 'ঞযধঃ ংযধষষ নব :যব ফবসড়পৎধঃরপ যিরপয ংযধষষ নব :যব ঢ়বড়ঢ়ষব, ভড়ৎ :যব ঢ়বড়ঢ়ষব'.এটার অনেক পরে আব্রাহাম লিঙ্কন তার এক ভাসনের মধ্যে ঠিক এমনই এক জনপ্রিয় সংজ্ঞা প্রদান করেন, তা হলো- 'এড়াবৎহসবহঃ ড়ভ :যব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু :যব ঢ়বড়ঢ়ষব, ভড়ৎ :যব ঢ়বড়ঢ়ষব.্থ- যার অর্থ হলো- 'গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য'।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার আত্মজীবনী 'দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স : ১৯৯৬-২০১২' বইটিতে লিখেছেন, 'কার্যকর সংসদীয় গণতন্ত্র তিনটি ডি-এর ওপর নির্ভরশীল : ডিবেট (বিতর্ক), ডিসেন্ট (বিরোধিতা) ও ডিসকাশন (আলোচনা)।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল পৃথিবীর অনেক দেশে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকাংশে পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর অনেক দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর মতো অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অনেক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কদের মতোই আচরণ করছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে। অনেক দেশে পরিপূর্ণ বেসামরিক সরকার থাকলেও সেখানে গণতন্ত্র কতটা কার্যকরী আছে সেটি নিয়ে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম- বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত বাঙালির সব রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের এক অবিসংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক রীতি ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তাই সুধীসমাজ কর্তৃক 'গণতন্ত্রের মানসপুত্র' বলে আখ্যায়িত হন তিনি। এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এই নেতার ভূমিকা অন্যতম। জনগণের দ্বারা, জনগণের মতো পথের ওপর নির্ভর করে এ দেশের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এ দেশ স্বাধীনতাপরবর্তী এই নিয়মের ওপর ভিত্তি করেই চলছে দেশ পরিচালনার কাজ। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও এই নিয়মের ভিত্তিতে কার্য পরিচালনা করে।
বর্তমানে এ দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা কতটুকু চলছে সে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ইয়োত্তা নেই।
মুখে সব দল গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে ক্ষমতায় এসে তারা কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠেন এবং দলের মধ্যে সুবিধাবাদী একটি গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়। দেশে যত অনিয়ম দুর্নীতি, গণতান্ত্রিক চর্চায় ছেদ, হত্যাকান্ডসহ যত অপকর্ম সংঘটিত হয়, তার সঙ্গে যুক্তরা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে যান। সবচেয়ে টানাটানিতে আছে এই গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশ। নানা মুনির নানা মত এই দেশে বর্তমান গণতন্ত্র চর্চা কতটুকু হচ্ছে তা নিয়ে। কোনো রাজনৈতিক দল কতটুকু কথা রেখেছে গণতন্ত্র বিকাশে? আসলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কতটুকু হয়েছে এ দেশ স্বাধীনতাপরবর্তী বা কোনো রাজনৈতিক দল এই গণতন্ত্রকে সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে সে নিয়ে এখন প্রতিনিয়তই চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে সর্বস্তরে চলে তুমুল বিতর্ক। এ উত্তরটা আসলে যে সঠিক দিতে পারবে সেটা হলো জনগণ।
দেশে বর্তমানে প্রধান দু'টি রাজনৈতিক দল হলো- ১। আওয়ামী লীগ এবং ২। বিএনপি।
এ দু'টি প্রধান রাজনৈতিক দল আজ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ নিয়ে পালটাপালটি বক্তব্য দিচ্ছে।
বর্তমান এ দেশে গণতন্ত্র সম্পর্কে বিরোধী দল বিএনপি'র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- 'বিদেশি পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশে কেন আসেন, সে প্রশ্ন তুলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কারণ এখানে গণতন্ত্র নেই, এখানে নির্বাচন হয় না। মির্জা ফখরুল বলেন, 'আজকে কথা হচ্ছে কেন বিদেশিরা আসছেন। আজকে আমেরিকা থেকে একটা টিম আসবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে একটা টিম এসেছে। কেন এসেছে, এই কথাটা বোঝা গেল যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই। অন্য দেশে তো তারা যায় না। এখানে আসে কেন? কারণ, এখানে গণতন্ত্র নেই। এখানে নির্বাচন হয়নি, এখানে নির্বাচন হয় না। বিএনপির মহাসচিব উলেস্নখ করেন, একটা নির্বাচনের জন্য প্রথম যে জিনিসটা দরকার হয়, সেটা হচ্ছে সবার জন্য সমান সুযোগ। সব রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই সমান সুযোগ পেতে হবে। কিন্তু এখানে সেই পরিবেশ নেই। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের একটা চরিত্রগত সমস্যা আছে, সেটা হচ্ছে তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তাদের পছন্দ একনায়কতন্ত্র। তারা মনে করে দেশে তারা ছাড়া ভিন্ন কেউ নেই। দেশের মালিক শুধু তারাই; এ রকম মানসিকতা তাদের। (তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ১১ জুলাই, ২০২৩)।
অপরপক্ষে, বর্তমান ক্ষমতাশীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গণতন্ত্র সম্পর্কে ভিন্ন বক্তব্য, তা হলো-
'আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'গণতন্ত্রকে নষ্টকারী বিএনপির মুখে গণতন্ত্রের বুলি শোভা পায় না। আমাদের গণতন্ত্র আমরাই চালাব। বিদেশি কারও ফরমায়েশে চলবে না।'
তিনি বলেন, 'বিএনপি গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ করেছে। তাদের মুখে গণতন্ত্রের বুলি মানায় না। এ দেশে গণতন্ত্রের যত অর্জন '৭৫ পরবর্তী গণতন্ত্রকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে তার অগ্রভাগে ছিলেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বেই গণতন্ত্র শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছে। শত বাধা বিপত্তির মধ্যেও শেখ হাসিনা গণতন্ত্র বিকাশে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।' ( তথ্য সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ২০ জানুয়ারি, ২০২৩)।
আবার এদিকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলা হচ্ছে।
আমরা আমজনতা। আমাদের রাজনীতি সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞান, ধ্যান-ধারণা ভালো নেই। আমাদের শ্রমের বিনিময়ে মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা করাই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। আমরা পরিবার নিয়েই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। বেলা শেষে দু'মুঠো ভাত- তথা মাছে ভাতে বাঙালি হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সর্বজন স্বীকৃত এটা যে শহীদ-গাজীর বাংলাদেশ, শাহাজালালের বাংলাদেশ, পীর আউলিয়াদের বাংলাদেশ, শেখ মুজিবের বাংলাদেশ। এ দেশের মা-মাটি রক্ষায় সবার অবদান অনস্বীকার্য। তাই আমরা আমজনতা হিসেবে চাইব দেশ, মা-মাটির কল্যাণে সাংবিধানিকভাবে জনগণের উন্নয়নে, জনগণের মঙ্গলার্থে দেশে সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।
রাজনৈতিক দলগুলো যেন কোনো সংঘাত নয়, আমাদের গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এ দেশ পরিচালনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে।
রায়হান আলী : আইনজীবী ও কলামিস্ট