মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক বলয়ে অর্থনীতি

সম্পদের অসম বণ্টন বর্তমান বিশ্বে একটি দুষ্ট গ্রহ। জনগণ ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য এই রাহুগ্রাস থেকে বের হয়ে আসা জরুরি।
আব্দুলস্নাহেল বারী
  ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
রাজনৈতিক বলয়ে অর্থনীতি

রাজনীতি জনগণের জন্য আর অর্থনীতি জনজীবনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে, তাই রাজনৈতিক বলয়ে অর্থনীতির স্বরূপ অনুধাবন প্রয়োজন। বাংলাদেশে অল্প শিক্ষিত জনগণ রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি ব্যক্তিক সংযোগ সম্পর্কে সজাগ নয়। গ্রামাঞ্চল কিছুটা পশ্চাৎপদ এবং শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে কম বিধায় ওই অসংযোগ প্রকটতর। কীভাবে বাজেট বরাদ্দের অর্থে এক ব্যক্তির প্রদত্ত শুল্কের টাকা অন্তর্ভুক্ত আছে বা রাষ্ট্রের গৃহীত ঋণের কিয়দাংশ সে পরিশোধ করে চলেছে সেটি জনগণ ওয়াকিবহাল নয়। তদ্রূপ রাষ্ট্রকে প্রদেয় ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রাপ্তি জনগণের নিকট স্পষ্ট নয়। এর ফলে, পরস্পর জনগণ ও রাষ্ট্রের মাঝে সম্পর্কও জবাবদিহিতায় ফারাক বিদ্যমান। উদাহরণ, ভোট প্রদানে জনগণের অহীনা।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো অতি সুদৃঢ়। বিশ্বে যুদ্ধবিগ্রহ, কোভিড-১৯ বা দেশে রাস্তা অবরোধ, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থাকে ঝাঁকাতে পারে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির বৃহদাংশ গ্রামীণ- যা সরকার কর্তৃক গৃহীত রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সন্নিবেশিত নয়। গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র বাংলাদেশের জিডিপির হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। হিসাবকৃত ৪১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ১৭০ মিলিয়ন মানুষের বর্তমানে দৃশ্যত জীবনযাত্রা মানের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। জনগোষ্ঠীর অতি বৃহদাংশ সরকারের প্রণীত বাজেট এবং গৃহীত প্রকল্পসমূহে প্রত্যক্ষ অংশীদার নয় এবং হিসাবে ৬.৩০ কোটি মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বেঁচে আছে এবং দৈনিক ২.০ মার্কিন ডলার আয় নির্ভর বাস্তব অবস্থা বর্ণনা করে না। গৃহ-অর্থনৈতিক-কর্মকান্ড- যা অতিবৃহৎ, সামগ্রিক দেশীয় অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না এবং জিডিপি বাস্তবে হিসবাকৃত জিডিপি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ। গ্রামীণ অর্থনীতি সরকার কর্তৃক গৃহীত রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি দ্বারা সামান্যই প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশে অর্থনীতি জনগণ কেন্দ্রিক হয়ে উঠেনি। বাংলাদেশে আপামর জনগণ ও সরকারের মাঝে বিদ্যমান ফারাক অতি বৃহৎ।

জনগণ ও রাষ্ট্র অবিচ্ছেদ্য, সরকার একটি স্বল্পস্থায়ী প্রতিষ্ঠান মাত্র এবং জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কই রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে সরকারের বৈধতা দেয়। তাই জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক অতি গুরুত্বপূর্ণ, সুদৃঢ় ও স্বচ্ছ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ওই দৃঢ়তা, স্বচ্ছতা বিধানের মাধ্যম। সরকারের রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড জনগণকে সম্পৃক্ত করে, জনগণ কেন্দ্রিক এবং সব জনগণের জন্য সমভিত্তিক হবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতিই জনগণ, রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যেকার সম্পর্ক ও জবাবদিহিতা অধিকতর নিশ্চিত করে বলে বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ধ্যান ধারণা যদিও গণতন্ত্র বর্তমানে দলতন্ত্রে পরিণত হয়েছে, বিভিন্ন দূষণে দুষ্ট এবং বিশ্বব্যাপী ব্যর্থতায় পর্যবসিত। এটা জনগণের শোষণের হাতিয়ার, পুঁজিবাদের ধারক, বাহক ও পৃষ্ঠপোষক। পুঁজিবাদ অর্থ ও সম্পদের কেন্দ্রীভূতির সুপ্ত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে সব অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কেন্দ্রীয়ানে সচেষ্ট। এটা সৃষ্ট

সম্পদের অসম বণ্টন বর্তমান বিশ্বে একটি দুষ্ট গ্রহ। জনগণ ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য এই রাহুগ্রাস থেকে বের হয়ে আসা জরুরি।

দ্রম্নত অধিকতর অর্জনের জন্য বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ থেকে হলে বাংলাদেশের দ্রম্নত সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করতে হবে। নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বিকেন্দ্রীকরণ ও দ্রম্নত সার্বিক উন্নয়নের সোপান হতে পারে। এই উদ্দেশ্যে কার্যকারী পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয় বাজেট বরাদ্দ এলাকা ও কেন্দ্রের মাঝে গ্রহণযোগ্য অনুপাতে বিভাজন করা যায়। নির্বাচনী এলাকার গণপ্রতিনিধি সাংসদ আন্তরিকতা, সততা, কর্মদক্ষতা এবং আইনানুগভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় তুলনামূলক ছোট পরিসরে নির্বাচনী এলাকায় দ্বায়িত্ব পালন করতে পারেন।

কেন্দ্র ও এলাকার মধ্যে কর্মকান্ড, যেমন, নৈমিত্তিক, সেবা ও উন্নয়ন ইত্যাদির দ্বায়িত্ব বণ্টন করা যাবে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদুৎ বা রাস্তার কথা উদাহরণ স্বরূপ ধরা যায়। কেন্দ্র এলাকায় বিদুৎকেন্দ্রে বিদুৎ সরবরাহ করে বিক্রি করবে, এলাকা বিদুৎ ক্রয়, বিতরণ, বিক্রি ও বিক্রি-উত্তর সেবা প্রদান করবে। মূল সড়ক কেন্দ্রের দ্বায়িত্বে থাকবে, এলাকায় রাস্তাঘাট এলাকার দ্বায়িত্বে থাকবে। কেন্দ্র ও এলাকার মধ্যে বাজেট বিভাজন জনগণ ও রাষ্ট্রের পক্ষে সরকারের মধ্যে একটি সেতু হিসেবে কাজ করবে। জনগণ কেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করবে। রাষ্ট্রীয় বাজেটের একটি অংশ সরাসরি এলাকায় ব্যয় হলে, জনগণ রাষ্ট্রের কাছে থেকে কি পেল তা প্রত্যক্ষ করবে এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অনুধাবন করবে। একজন গণপ্রতিনিধির ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য, তার স্বভাব, চরিত্র, সুস্বাস্থ্য, কর্মক্ষমতা, আন্তরিকতা, সততা, দূরদর্শিতা ও মনন ইত্যাদির গুরুত্ব অনুধাবন করতে সচেষ্ট হবে- কারণ সাংসদ প্রত্যক্ষভাবে তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে। জনগণ যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট প্রদানে অধিক সজাগ হবে।

শতকরা ২৫/৩৫/৪৫ ভাগ সরাসরি এলাকা পেতে পারে এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি প্রশাসনিক, আর্থিক ও অন্যান্য কর্ম পদ্ধতির দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে। এলাকার প্রাপ্তি মাথাপিছু হিস্যা হওয়াই যথাযথ। তবে কাস্টেড ভোট সংখ্যাভিত্তিক হলে গুটি কতক অর্জন বৃদ্ধি পাবে। ভোট সংখ্যাভিত্তিক হলে ভোটে জনগণের অংশগ্রহণ স্বপ্রণোদিত ও নিশ্চিত হবে। নির্বাচনে স্বল্প কাস্টেড ভোটের দূষণ দূর হবে। অতি অধিক ভোটার উপস্থিতি ঘটবে বিধায় ভোট কারচুপি দূর হবে, প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব অকার্যকর হয়ে পড়বে। জনগণের রাষ্ট্রীয় অধিকার ভোট এবং ভোট সরকার ও রাষ্ট্রের সেতুবন্ধন। ভোটের সঙ্গে প্রাপ্তির সরাসরি সংযোগ না থাকায় অধনী দেশে ভোটের গুরুত্ব জনসাধারণ মূল্যায়ন করে না। নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব না হলেও বর্তমানে ভোটদানে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার জন্য জনগণকে আহ্বান করতে হয়, উৎসাহ উদ্দীপনার মাঝে ভোটগ্রহণ মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। কাস্টেড ভোট সংখ্যাভিত্তিক বিভাজন গণতন্ত্রের পরিচিত কিছুটা দূষণ দূর করবে।

রাজধানী, সমুদ্রবন্দর, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইত্যাদির অবদান বা জনগণের প্রাপ্ত উপকার এক ব্যক্তির অবস্থানের দূরত্ব কমতে থাকে কিন্তু রাষ্ট্রীয় এ সব সম্পদের উপকার পাওয়ার অধিকার সব নাগরিকের সমান এবং রাষ্ট্রই ওই অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করবে। এলাকাভিত্তিক বিভাজন পদ্ধতি অর্থাৎ দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে প্রাপ্তব্য অংশ বৃদ্ধি এর আংশিক সমাধান দিতে পারে। সরকারের কর্মকান্ড জনগণের অর্থ পুষ্ট। নির্বাচনী এলাকা রাষ্ট্রীয় অর্থ ভান্ডারে আর্থিক অবদান রাখতে পারে।

আব্দুলস্নাহেল বারী : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে