আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালি জাতির গৌরব ও অহংকারের এক মহান অধ্যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার আলোয় উদ্ভাসিত করে বাঙালি বীরের জাতি হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিল। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালিকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে। অমিত সাহস নিয়ে বাঙালিরা ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। উদিত হয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। রচিত হয় বিজয়ের বীরত্বগাথা। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা প্রায় চার লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারায়। হতভাগিনী বাঙালি নারীদের সম্ভ্রম আর অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করতে পেরেছি স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি অসীম সাহসিকতার সঙ্গে নারীরাও সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে বাঙালি নারীরা অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে। বাঙালি মরণপণ যুদ্ধ করে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। বাঙালির বীরত্বে পরাজিত হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দখলদার হানাদার বাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সগৌরবে ওড়ে বিজয়ের পতাকা। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের বিজয় এক দিনে আসেনি। স্বাধীনতা সংগ্রাম একাত্তরের নয় মানের মুক্তিযুদ্ধে সীমাবদ্ধ নয়। এই বিজয়ের পেছনে আছে বাঙালির শৌর্য, বীর্য, দীর্ঘ সংগ্রাম ও সর্বোচ্চ ত্যাগের ইতিহাস।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বর্ষ ভেঙে আলাদা দুটি দেশের জন্ম হয়। একটি ভারত অন্যটি পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ার পর পাকিস্তানের পূর্ব অঞ্চলে শোষণ বঞ্চনা ও বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে পূবার্ঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের যুক্ত করে। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই ছিল বাঙালি। তাদের মাতৃভাষা বাংলা। তবু পাকিস্তানি ক্ষমতাসীনরা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার কুটিল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি পাকিস্তানিদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সে কারণে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের রয়েছে ভিন্ন তাৎপর্য।
১৯৫৪ সালে পূবর্বাংলা আইন পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরাজিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসনে জয় লাভ করে। অন্যদিকে, মুসলিম লীগ ১০টি আসন পায়। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পাকিস্তান সরকার ৫৬ দিন মন্ত্রিসভার কাযর্ক্রম চালু রাখে। ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত আওয়ামী লীগ ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন চালু করে। এ সময় রাজনৈতিক কাযর্ক্রম বন্ধ করা হয় এবং ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার চলানো হয়। বাঙালি ক্ষোভে বিক্ষোভে জ্বলে ওঠে। গড়ে তোলে শক্ত প্রতিরোধ। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন মূলধারার রাজনীতির স্রোতধারাকে বেগবান করে তোলে। পাকিস্তানি শাসকবর্গের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে ছাত্ররা 'শরীফ কমিশন রিপোর্ট প্রত্যাহার আন্দোলন তীব্র করে তোলে। আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ১৩ ফেব্রম্নয়ারি ৬ দফা উত্থাপন করেন। সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চার পাশাপাশি ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার, দুই পাকিস্তানের মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে আনা, ট্যাক্স ধার্য ও বৈদেশিক মুদ্রার স্বতন্ত্র হিসাব নির্ধারণ' ও প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠনের ক্ষমতা অর্জনসহ বিবিধ বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ছয় দফার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম তীব্রতর হয়। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করে আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়। ঢাকা সেনানিবাসে বিচার শুরু হয়। ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। এ সময় আন্দোলন চলাকালে সার্জেন্ট জহরুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা, ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান ও মতিউর রহমানকে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের ঘাতক বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। সারাদেশ আন্দোলন সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। সরকার বাধ্য হয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয় অবশেষে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ছাত্রসমাজ পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা প্রদর্শন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে ১১ দফা ঘোষিত হয়।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি রেসকোর্সের ময়দানে শেখ মুজিুবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ১৯৭০ সালের নিবার্চনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদে বসতে না পারায় জনগণের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে পাঁচ দিন হরতাল পালিত হয়।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সামরিক বাহিনীর সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় প্রাধান্য পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। এ সময় বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাঙালি স্বাধীনতার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা করার কথা বলে শুধু সময় ক্ষেপণ করতে থাকে। ইতোমধ্যে বেলুচিস্তানের জেনারেল টিক্কা খানকে পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। আলোচনার নামে প্রহসন চলতেই থাকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নেমে আসে এক ভয়াল বিভীষিময় রাত।
\হ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের নীলনকশা অনুযায়ী রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গণহত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। এই সংবাদ বিদেশি গণমাধ্যমে যাতে প্রচার না করা হয় সে কারণে বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালানো হয়। গুঁড়িয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন স্থাপনা। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকায় গণহত্যা পরিচালনা করে। পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করে আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকার ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বেতার বার্তার মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় তিনি বলেন, 'এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন আপনাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে দখলদার বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে'।
\হবাঙালিরা সর্বত্র দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেনাবাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করে। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিসেনারা প্রতিরোধ সংগ্রামে নিজেদের যুক্ত করে।
\হমুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বিপস্নবী সরকার। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলায় মুজিব নগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের শেষলগ্নে বাঙালিরা হারায় তাদের দেশের শ্রেষ্ঠ মন্তান বুদ্ধিজীবীদের। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা যখন চূড়ান্ত বিজয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ঠিক তখনই এ দেশীয় নরঘাতক রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত মিত্র বাহিনীর অবিরাম আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়। আসে বিজয়ের ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালি পরাধীনতার শেকল ভেঙে অর্জন করে স্বাধীনতা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে নেমে আসে চরম বির্পযয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। তারপর দীর্ঘ ২১ বছর দেশ পরিচালনার নামে স্বাধীনতার চেতনাকে হত্যা করার অপচেষ্টা চালানো হয়।
এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী হয় স্বাধীনতা বিরোধীরা। তাদের গাড়িতে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ে। এ সবকিছু আমাদের নীরবে দেখে যেতে হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা বেড়ে যায় ভীষণভাবে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ধ্বংস করার চক্রান্ত চালায়। এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দুঃসময় থেকে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি মিলেছে। বাংলাদেশকে এখন আর অনগ্রসর দেশ বলা যায় না। আর্থসামাজিক উন্নতি বেড়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। ক্রমাগত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠছে।
মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে একদিন সত্যিই স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী শক্তি দূরে সরে যাবে। কোনো কবি উদ্ভট উটের পিঠে স্বদেশের যাত্রা দেখে কষ্ট পাবে না। স্বাধীনতার স্বপ্ন ঠিকই পৌঁছে যাবে অভীষ্ট লক্ষ্যে।
সাগর জামান: কবি ও প্রাবন্ধিক