সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাকওয়া অর্জনে মাহে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

বৈচিত্র্যের এত রকমফের, ইবাদতের এত মোহনা, সংযমের এমন দৃষ্টান্ত সচরাচর অন্যান্য মাসে দেখা যায় না। সুতরাং রমজান মাসে তাকওয়া অর্জন করা সব মুমিনের কর্তব্য।
মো. জিলস্নুর রহমান
  ১৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

পবিত্র মাহে রমজান রহমত, বরকত, মাগফিরাত- এ তিনের সমন্বয়ে সুসজ্জিত। আমলের অনুশীলন ও তাকওয়া অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাস। এ মাসেই মুমিনের পৃথিবী সেজে ওঠে নেক আমলের আধিক্যে। মাহে রমজান ও তাকওয়ার মাঝে নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। কেননা, রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তিকে অবশ্যই তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে হয়। বছরের এক মাসব্যাপী সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য নিছক উপবাস থাকা নয়, এর মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা, অন্তরে আলস্নাহ ভীতি তৈরি করা, সমস্ত পাপাচার থেকে দূরে থাকা এবং রমজানের সমস্ত আমল সারা বছর অনুশীলন ও অনুসরণ করা। তাই মুসলমানদের তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে মাহে রমজানের পূর্ণাঙ্গ একটি মাস রোজা পালন করা ফরজ করা হয়েছে।

মহান আলস্নাহ বলেন, 'রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হেদায়েতস্বরূপ এবং হেদায়েতের সুস্পষ্ট নিদের্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে (সুরা বাকারা ১৮৫)'। মহান আলস্নাহর এ বাণী দ্বারা বোঝা যায়, রমজান কেন অন্য মাসের চেয়ে মহিমান্বিত, শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ। নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নবী আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (সা.), আসমানি গ্রন্থসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পবিত্র কোরআনুল কারিম, আর শ্রেষ্ঠ নবীর ওপর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ যে মাসে নাজিল হয়েছে সেটি মাহে রমজান। অতএব, শ্রেষ্ঠ নবীর ওপর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ নাজিলের মাস রমজান অন্য মাসসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এ কারণে নিঃসন্দেহে রমজান মাস অন্য মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময়।

তাকওয়া একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ভয় করা, আত্মরক্ষরা করা, বেঁচে থাকা ইত্যাদি। আর ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় তাকওয়া বলতে আলস্নাহর ভয়ে ভীত হয়ে জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য সব ধরনের পাপাচার থেকে আত্মরক্ষা করাকে বোঝায়। তাকওয়া হলো মুমিনের আত্মার এমন এক শক্তি, যা তাকে সর্বদা আলস্নাহর ভয়ে ভীত রাখে। সে সদাসর্বদা এই ভয়ে ভীত থাকে যে জীবনের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র যেকোনো কাজেও যদি আলস্নাহর হুকুম অমান্য করা হয়, তাহলেও কিয়ামতের দিন সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে এবং জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাই মুমিন ব্যক্তি সব সময় নিজের আত্মার বাধ্যবাধকতায় নিজ জীবনের যাবতীয় কর্মকান্ড খোদাই বিধানের আলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।

অতএব বলা যায় তাকওয়ার অর্থ হলো, জীবনকে আত্মনিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। পাপ প্রবণতা মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য। ফেরেশতাদের মধ্যে পাপ করার যোগ্যতাই নেই। তাই তারা কিয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘ হায়াত পাওয়ার পরও কোনো পাপাচার করতে পারে না। বিপরীতে মানুষের মধ্যে রয়েছে তার নাফ্‌স, যা তাকে সব সময় পাপাচারের দিকে আকৃষ্ট করে। আর বিতাড়িত শয়তান মানুষকে মহান আলস্নাহর অবাধ্যতার পথে ধাবিত করতে পণ করেই পৃথিবীতে এসেছে। সুতরাং মানুষ পাপ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। পাপ করার পরে মানুষ অনুতপ্ত হবে, নিজের পাপের জন্য মহান আলস্নাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। মহান আলস্নাহ বান্দার সব পাপ মাফ করবেন, তার আমলনামায় পাপের জায়গাটা পুণ্য দিয়ে ভরে দেবেন। মানুষ ফেরেশতার চেয়ে বেশি মর্যাদাবান হওয়ার আসল কারণ এটাই। আর মুমিন বান্দার পাপ থেকে মুক্তি লাভের মহান সুযোগ নিয়ে প্রতি বছর একবার করে আসে মাহে রমজান।

মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্যই হলো তাকওয়া অর্জন। কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, 'হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের ওপর রোজা পালন ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যেমনি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর, আশা করা যায় যে, রোজা পালনের মধ্য দিয়ে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে (সুরা বাকারা ১৮৩)। উলিস্নখিত আয়াতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা মহান আলস্নাহর পরিষ্কার নির্দেশনা প্রত্যাশা করি। প্রথমত, মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা কোনোমতেই ঐচ্ছিক ইবাদত নয়, বরং এটি সমুদয় মুসলিম মিলস্নাতের ওপর অবশ্য পালনীয় তথা ফরজ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ রোজা পালনের বিধান আকস্মিকভাবে আমাদের ওপর অবধারিত করা হয়নি, বরং এটি আগেকার বহু জাতি-গোষ্ঠীর ওপরও ফরজ হিসেবে সাব্যস্ত ছিল এবং তৃতীয়ত, রমজানের সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্যই হলো তাকওয়ার গুণাবলি অর্জনে বান্দা নিজেকে সমৃদ্ধ করবে। তাকওয়ার স্থান হলো অন্তর। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এটি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আলস্নাহ বলেন, 'আর তোমরা আলস্নাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আলস্নাহ অন্তরের বিষয়ে বিশেষ অবগত' (সুরা মায়েদা ৭)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, মুসলিম মুসলিমের ভাই, সে তার ওপর জুলুম করে না এবং তাকে সঙ্গীহীন ও সহায়হীনভাবে ছেড়ে দেয় না। সে তার কাছে মিথ্যা বলে না ও তাকে অপমান করে না। তাকওয়া হচ্ছে-এখানে, তিনি নিজের বুকের দিকে ইশারা করেন (মুসলিম ২৫৬৪)।

\হকোরআন-সুন্নাহে তাকওয়া অর্জনের অনেক উপায় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমত, কোনো মুসলমান যদি পবিত্র কোরআনকে ভালোভাবে পড়ে বুঝতে পারে, তাহলে পবিত্র কোরআন তার অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করবে। মহান আলস্নাহ বলেন, ্তুনিশ্চয় আমি এ কোরআনে মানুষের জন্য সব দৃষ্টান্তই বর্ণনা করেছি, যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে। বক্রতামুক্ত আরবি কোরআন, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে (সুরা জুমার, ২৭-২৮)। পবিত্র কোরআনে মহান আলস্নাহ সিয়ামের বিধিবিধান বর্ণনা করার পর বলেন, 'এভাবেই আলস্নাহ তার আয়াতসমূহ মানুষের জন্য বিস্তারিত বর্ণনা করেন, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে' (সুরা বাকারা ১৮৭)। মহান আলস্নাহর পরিচয় লাভ করার অনন্য এক মাধ্যম হলো পবিত্র কোরআন। কোনো মানুষ যখন পবিত্র কোরআন নিয়ে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে, তখন আলস্নাহ তার শান-শওকাত, মহত্ব, তার গুণবাচক নামসমূহ ও গুণাবলির মাধ্যমে তার সামনে প্রকাশ হন। দ্বিতীয়ত, এখলাসের সঙ্গে আলস্নাহর ইবাদত করা। মহান আলস্নাহর ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়, সেটা ফরজ ইবাদত হোক কিংবা সুন্নত, নফল। এরশাদ হচ্ছে, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করো, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো (সুরা বাকারা ২১)। যেসব ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়, তন্মধ্যে একটি ইবাদত হলো 'সিয়াম'। তৃতীয়ত, আলস্নাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা। মহান আলস্নাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করার মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। আলস্নাহ বলেন, 'নিশ্চয় রাত ও দিবসের বিবর্তন এবং আসমানসমূহ ও জমিনে যা আলস্নাহ সৃষ্টি করেছেন, তাতে বহু নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে (সুরা ইউনুস ৬)। চতুর্থত, পরকাল ও তার ভয়াবহতা বিষয়ে কোরআনের আয়াত ও রাসুলের (সা.) হাদিস পাঠ করা। কবর ও তার আজাব এবং পরকাল ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত ও হাদিসগুলো বেশি বেশি অধ্যয়ন করার মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। আলস্নাহ বলেন, 'তাদের জন্য তাদের ওপর দিকে থাকবে আগুনের আচ্ছাদন আর তাদের নিচের দিকেও থাকবে (আগুনের) আচ্ছাদন; এ দ্বারা আলস্নাহ তাঁর বান্দাদের ভয় দেখান। হে আমার বান্দারা! তোমরা আমাকে ভয় করো (সুরা জুমার ১৬)। রমজান মাস যেমন অন্য মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী, রমজান মাসে অবস্থিত পবিত্র ও মহিমান্বিত রজনী শবেকদর যেমন বছরের অন্য সব রাতের ওপর মর্যাদাশীল, ঠিক তেমনি মানবজীবনের অপরাপর সব গুণের ওপর তাকওয়ার গুণ শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। তাকওয়ার এই গুণাবলি মানুষকে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত করে এবং সর্বোন্নত মর্যাদার আসনে তাকে সমাসীন করে। এমনকি মহান আলস্নাহর কাছেও তাকওয়ার গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত। ইরশাদ হচ্ছে, 'তোমাদের মধ্যে আলস্নাহর কাছে সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান (সুরা হুজরাত, আয়াত ১৩)। এ আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, মহান আলস্নাহর কাছে বান্দার সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি হলো তাকওয়া; মাহে রমজানের সিয়ামব্রত পালনের মাধ্যমে যে অমূল্য গুণটি অর্জিত হয়। তাকওয়া মানে আলস্নাহ ভীতি, পরহেজগারি, সাবধানতা অবলম্বন, সংযম সাধন, আত্মরক্ষা করা, বাঁচা, নিষ্কৃতি লাভ প্রভৃতিকে বোঝায়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, 'রাসুল তোমাদেরকে যা শিক্ষা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাকো এবং তোমরা আলস্নাহর তাকওয়া অবলম্বন করো; নিশ্চয় আলস্নাহ শাস্তি দানে কঠোর।' (সুরা আল হাশর ৭)। এ আয়াতে নির্দেশিত বিষয়ের সারকথা হলো গ্রহণ ও বর্জন; যা কিছু ভালো সেগুলো গ্রহণ করা আর যা কিছু মন্দ সেগুলো পরিহার করা। তাকওয়ার বিষয়টি এমনই। অর্থাৎ একই সঙ্গে করণীয় বিষয়ে কর্তব্য পালন ও বর্জনীয় বিষয়াবলি পরিহারের সমষ্টিই তাকওয়া। সর্বক্ষেত্রে সাবধানি আচরণ এবং হিসেবি জীবন যাপনের নামই হলো তাকওয়া। কর্দমাক্ত রাস্তা অতিক্রমকালীন যেমন সবাইকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, ঠিক তেমনি জীবনের আঁকাবাঁকা, বন্ধুর ও পিচ্ছিল রাস্তায় চলতে গিয়েও সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান মাসের ইবাদতের সওয়াব অনেক বেশি। রাসুলুলস্নাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'যে ব্যক্তি এ মাসে নফল ইবাদত করল, সে যেন অন্য মাসের ফরজ ইবাদত পালন করল। আর যে এ মাসে একটি ফরজ পালন করল, সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরজ ইবাদত করল।' অর্থাৎ অন্য মাসে একটি ফরজ ইবাদতে যে সওয়াব, এ মাসে তা নফল দ্বারাই পাওয়া যায়। আর অন্য মাসের ৭০টি ফরজের সওয়াব এ মাসের একটি ফরজ দ্বারা অর্জন করা যায় (বায়হাকি শুয়াবুল ঈমান)। রহমত, মাগফিরাত, নাজাত, রোজা, সাহরি, ইফতার, তারাবিহ, লাইলাতুল কদরসহ আরও বহু অনন্য বরকতময় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এ পবিত্র মাস সন্দেহাতীতভাবে অন্য সব মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

বৈচিত্র্যের এত রকমফের, ইবাদতের এত মোহনা, সংযমের এমন দৃষ্টান্ত সচরাচর অন্যান্য মাসে দেখা যায় না। সুতরাং রমজান মাসে তাকওয়া অর্জন করা সব মুমিনের কর্তব্য।

মো. জিলস্নুর রহমান : ব্যাংকার ও কালাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে