সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

তরুণদের মুক্তিযুদ্ধ ভাবনা

তরুণ সমাজ নিজেদের আপন মহিমায় গৌরবান্বিত হবে এবং দেশমাতৃকার জন্য নিজেদের গড়ে তুলবে। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের কাছে তরুণ সমাজ এ বিষয়ে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ।
নাফিউল ইকবাল
  ১৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

তারুণরা একটি দেশের জীবনীশক্তি। এই প্রাণশক্তি যা অফুরন্ত সম্ভাবনা ও বর্ণিল স্বপ্ন দ্বারা উজ্জীবিত থাকে। তরুণরা একটি জাতিরসত্তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানবসম্পদ এবং তারাই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা কুড়িয়ে পাওয়া বা বদান্যতার উপহার নয়। এ দেশ সুদীর্ঘ রক্তঝরা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দেশ। তরুণ সমাজের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অপরাজেয় সাহসীকতার কারণেই অর্জিত হয়েছে এ মহান স্বাধীনতা। বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখতে পারবে না তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি কালজয়ী ইতিহাসের নাম। আর সেই ইতিহাস থেকে জ্ঞানলাভের জন্য সচেষ্ট বর্তমান তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তির পাঁচ দশকের পরও তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ একটি সাহস ও আত্মবিশ্বাসের নাম। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা এবং যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন এই মুক্তিযুদ্ধই থাকবে শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধ্যায় হিসেবে, অবিস্মরণীয় এক গৌরবগাথা হিসেবে। বাঙালির ইতিহাস মানে না পাওয়া আর বেদনার ইতিহাস। আজকের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে উপস্থাপন করা, তুলে ধরা। আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন যে তরুণ সমাজ, তাদের আমরা দেশের সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে রাখতে চাই। তাদের ওপরই ভরসা রাখতে চাই। বর্তমানে একটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশি তরুণরা এত বেশি দেশ ছাড়তে চায়। কিন্তু কেন? তরুণদের এই প্রবণতাকে কোনোভাবেই নেতিবাচক বলতে পারি না। তবে অধিকাংশ মানুষ দেশের বিভিন্ন অস্থিতিশীল সমস্যার কারণেই দেশে প্রতি বিরাগ। তৎকালীন সময়ে দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের লড়াইয়ের নেতৃত্বদান ও যুদ্ধ-পরবর্তী একটি বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে তৎকালীন তরুণদের অবদান বাঙালি জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বদেশে থেকে স্বদেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ও সাহসিকতা নিয়ে কাজ করার মাধ্যমেই দেশেই উন্নয়ন সম্ভব। তরুণ প্রজন্মই পারবে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে। ১৯৭১ সালে শুধু এক শ্রেণির মানুষের সুবিধা ভোগের জন্য স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। সে সময় দেশমাতৃকার প্রবল টানে দল-মত-নির্বিশেষে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতাসংগ্রামে। উদ্দেশ্য ছিল, খাই বা না খাই আমরা সব বাঙালি একই ছায়াতলে থাকব। এমন ধ্রম্নব সত্য বিবেচনায় বাঙালি জাতি এক হয়েছিল। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা, কারও প্রতি বৈষম্য নয়। স্বাধীনতার প্রকৃত লক্ষ্য যদি বৈষম্য, একচ্ছত্র অধিকারতন্ত্র হতো, তবে অনেক আগেই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হতো। স্বাধীনতা বিলুপ্ত না হলেও বাংলাদেশে স্বাধীনতার চরম অপব্যবহার চলছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি সুন্দর দেশ গড়তে স্বাধীনতার অপব্যবহার রুখতে হবেই। সব প্রতিনিধিত্বমূলক বিষয়ে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ করে দিতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যে মর্যাদা, আত্মবিশ্বাস, অহংকার, সততার শিক্ষা, মাথা উঁচু করে চলার উজ্জীবনী শক্তি, ন্যায় বলার, প্রতিবাদী হওয়ার ও দেশের জন্য কিছু করে যাওয়ার অধিকার দিয়েছে তা দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। নবীন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতাকে তুলে ধরে এর চেতনাকে তাদের হৃদয়ে ধারণ করানোর এখনি আদর্শ সময়। পাকিস্তানিদের নির্যাতন-নিষ্পেষিত শাসন-শোষণ-বঞ্ছনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি চূড়ান্তভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এরপর সেই ঐক্যে ভাটা পড়ে। বিজয়ের ৫৩ বছর পরও জাতির অনৈক্যের সুর বাজে, যা দেশকে দারুণভাবে আহত করে। তরুণ প্রাণকে আহত করে। নতুন প্রজন্মের তরুণরা বিজয় দেখেনি। কিন্তু বিভিন্নভাবে শুনেছে, জেনেছে সেই বিজয়ের গল্পকথা। বাঙালির ঐক্যবদ্ধতার ইতিহাস যেন কেবল পাঠ্যপুস্তক ও গল্প হয়ে না থাকে। এই ইতিহাস থেকে যেন আমরা শিক্ষা লাভ করতে পারি সব বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন এই মুক্তিযুদ্ধই থাকবে শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধ্যায় হিসেবে, অবিস্মরণীয় এক গৌরবগাথা হিসেবে। কারণ বাঙালি জাতি জন্ম থেকেই কোনো না কোনো শাসক দ্বারা শোষিত হয়েছে, অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছে। কখনো মোগল-পাঠান, কখনো ব্রিটিশ, কখনো পাকিস্তানিদের দ্বারা। জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা যে জীবনকে তুচ্ছ করে, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেশমাতা ও মাতৃভূমিকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল, তা নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে। নতুন প্রজন্মকে এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। কারা সেই চেতনা ধারণ করছে তা জানতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ঐতিহাসিক লেখা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যতালিকার রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ভালো মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ যে স্বাধীন হয়েছে সে বিষয়টি নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে অনুধাবন করতে হবে। এখন সময় এসেছে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ চিহ্নিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি বিষয়কে কেবল একটি অধ্যায়ে বোঝানো সম্ভব নয়। আবার পাঠ্য বইয়ের সূচিও সীমাবদ্ধ। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য ঢেকে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সত্য কখনো চাপা থাকে না। তা ঠিক বেরিয়ে আসে। সেসব কথাই তাদের বলতে হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে বিস্তারিতভাবে জানাতে হবে। সঠিক তথ্যটা তাদের দিতে হবে। নিজের প্রচেষ্টায় তরুণ সমাজ এই ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী আত্মত্যাগের গল্প, তাদের যুদ্ধের লক্ষ্য, স্বাধীন দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য এসব বোঝাতে হবে। মোটকথা কোনটা স্বাধীনতার চেতনা আর কোনটা স্বাধীনতার চেতনা নয়, তার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের কথা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু আমরা দেখি সময় যে সরকার আসে, সে সময় ইতিহাসে বিভিন্ন পরিবর্তন আসে। নিজের চাহিদা বা সুবিধামতো ইতিহাসের পরিবর্তন করে নেওয়া হয়। এই পরিবর্তন তো একটি জাতির জন্য সুখের বিষয় নয়। ইতিহাস বিকৃতি একটি জাতিকে ধ্বংস আর বিভ্রান্ত করারই নামান্তর। বাংলাদেশের সব গৌরবময় অর্জন ও স্বাধীনতাসংগ্রামের তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করে ১৯৭১ সালকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তলাবিহীন ঝুড়িখ্যাত বাংলাদেশ কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো উত্থান হয়েছে স্বগৌরবে। তরুণদের স্বপ্নগুলো হবে বাংলাদেশের স্বপ্ন। তরুণদের ভাবনায় ভাবতে হবে। তাদের ভাবনাই এই দেশের ভাবনা।

তরুণ সমাজ নিজেদের আপন মহিমায় গৌরবান্বিত হবে এবং দেশমাতৃকার জন্য নিজেদের গড়ে তুলবে। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের কাছে তরুণ সমাজ এ বিষয়ে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ।

নাফিউল ইকবাল : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে