বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্ররাজনীতি বিমুখ বর্তমান প্রজন্ম

আদর্শের মোড়কে অপরাজনীতি যেন ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রধান কাজ। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সুনাম ছিল আকাশচুম্বী। ছাত্র সমস্যা সমাধান ও ছাত্র অধিকার আদায়ে ছাত্রলীগ ছিল অন্যতম এক ভরসার জায়গা।
শেখ সাদী ভূঁইয়া
  ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ছাত্ররাজনীতি বিমুখ বর্তমান প্রজন্ম

পরিচিত রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্য হওয়া কি-ই ছাত্ররাজনীতি? নাকি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বাইরে থেকেও ছাত্ররাজনীতি করা যায়? যদি তাই হবে- তবে ছাত্ররাজনীতি বিমুখ কেন বর্তমান প্রজন্ম? সম্প্রতি বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি থাকা না থাকার বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে রয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, রয়েছে লাভ-ক্ষতির হিসাব, শঙ্কা রয়েছে জীবন নাশের, উঠে আসছে নানান প্রশ্নের ট্রায়াংগেল। শিক্ষা ও গবেষণার পথে ছাত্ররাজনীতি কি অন্তরায়? বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বাধীনতাপরবর্তী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও দেশের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোতে যৌক্তিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রসমাজ। বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডটি বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্র সংগঠন 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগ'র ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নসহ বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের অবদানও অস্বীকার করা যায় না। সময়ের পরিক্রমায় ছাত্ররাজনীতির প্রতি অনীহা ও ঘৃণা প্রকাশ করছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা। চলুন একটু ফিরে দেখা যাক দেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্ররাজনীতির নানান কর্মকান্ড।

ছাত্র সংগঠনগুলো এমন কী কর্মকান্ড করেছে- যার ফলে রাজনীতির প্রতি বিমুখ দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক শিক্ষার্থীরা। নাকি ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা আদর্শকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শুধু নিজেদের স্বার্থ হাসিলে মত্ত? উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও ছাত্র ইউনিয়নসহ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নাম সবার কাছে পরিচিত। সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে যে বিষয়টি বৃহৎ আকারে চলে সেটি হলো 'ট্যাগের রাজনীতি'। নিজের দলের কারো প্রতি দ্বিমত বা কোনো কিছু সহ্য করে নিতে না পারলে ভিন্ন মতাদর্শী লোক বলে চালিয়ে দেওয়ার রাজনীতি এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই ট্যাগের রাজনীতি যেন হরহামেশাই দেখা মেলে।

নানান ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় থাকে দেশের ধর্মভিত্তিক ছাত্রসংগঠন 'ছাত্রশিবির'। বর্তমান সময়ে প্রকাশ্যে সংগঠনটির তেমন কোনো কার্যক্রম না থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ছবি ভিডিও দেখলে বোঝা যায় তাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শিবির বর্তমানে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার একমাত্র সংগঠন বলে দাবি করে। অথচ দেশ-বিদেশে তাদের নামে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও ধর্মীয়/মৌলবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার অভিযোগ রয়েছে। স্বাধীনতার সময় মুক্তিযুদ্ধে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সংগঠনটির সাবেক কয়েকজন শীর্ষ নেতার ফাঁসিও কার্যকর করেছেন উচ্চ আদালত। জ্বালাওপোড়া ও সহিংসমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকা ও স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি নামে পরিচিত ছাত্রশিবির আস্থা হারিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে। এছাড়াও প্রগতিশীল যুগে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারণেও ছাত্রশিবিরের অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ধর্মীয় আদর্শের মোড়কে শিবিরের রাজনীতি সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। বলা যায়, ধর্মীয় আদর্শের ছায়ায় তারা মৌলবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। তবে জানা যায়, বাংলাদেশের দুটি বৃহৎ সংগঠন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিভিন্ন সময় তাদের প্রয়োজনে জামায়াত-শিবিরকে ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে।

তবে, এক্ষেত্রে বামপন্থি সংগঠনগুলোর প্রতি এরকম অভিযোগ নেই বললেই চলে। '৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে '৭১-র স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রলীগের পাশাপাশি যে সংগঠনটি সমানুপাতিক ভূমিকা রেখেছে সেটি হলো বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। এছাড়াও ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা উলেস্নখযোগ্য। বামপন্থি সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের যে কোনো যৌক্তিক দাবি নিয়ে বরাবর মাঠে থাকলেও ছাত্রসমাজের মাঝে নিজেদের বিস্তৃত করতে পারেনি। পত্রপত্রিকা খোঁজাখুজি করে দেখা যায় বাম সংগঠনগুলোর কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে কিছু যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে দেশবিরোধী কর্মকান্ডে তাদের তৎপরতা চোখে পড়েনি।

বাংলাদেশের অপর একটি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। টানা চারবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলকে এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। কিছু ঝটিকা মিছিল ও হঠাৎ কর্মসূচি পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে ছাত্রদল। যে সময়ে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলো নিয়ে ছাত্রসমাজের কাছে গিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার কথা সে সময়ে পদ-পদবি নিয়ে সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত যেন চরমে। ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় খুন-গুম, মাদক, অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, হল দখল, সিট বাণিজ্যসহ নানান অপরাধে জর্জরিত ছিল ছাত্রদল। নিজেদের অস্তিত্ব হারানোর মুহূর্তেও বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত থাকার শিরোনাম ছিল ছাত্রদলের সাধারণ ঘটনা। ছাত্রলীগের মতো এই ছাত্রসংগঠনেও চলে ট্যাগের রাজনীতি। পল্টনে ছাত্রদলের দু'গ্রম্নপের সংঘর্ষ হলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাহেব একটি গ্রম্নপকে সরকারের দালাল বলে মন্তব্য করেন। শুধু এখানেই দালাল ট্যাগ সীমাবদ্ধ নয়, দলের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ হলে একে অপরকে দালাল বলে আখ্যায়িত করার নজির রয়েছে অহরহ। ছাত্রদলের বিভিন্ন কর্মকান্ডের ইতিহাস দেখলে বলতে হবে- তাদের স্স্নোগান শিক্ষা, ঐক্য ও প্রগতির সঙ্গে কোনো মিল নেই। এই স্স্নোগানের ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে ছাত্রদল।

বলা যায়, আদর্শের মোড়কে অপরাজনীতি যেন ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রধান কাজ। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সুনাম ছিল আকাশচুম্বী। ছাত্র সমস্যা সমাধান ও ছাত্র অধিকার আদায়ে ছাত্রলীগ ছিল অন্যতম এক ভরসার জায়গা।

\হটানা চারবারের মতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় এশিয়া মহাদেশের বৃহৎ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে জনমনে এখন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে, ছাত্রলীগ কি আসলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাবে নাকি নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ও স্বার্থ রক্ষায় জনসম্পৃক্তহীন হয়ে পড়বে? বিগত বছরগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কর্মকান্ডে পজিটিভ শিরোনামের চেয়ে বেশি নেগেটিভ শিরোনাম জায়গা করে নিচ্ছে। ছাত্রদলের মতো ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রয়েছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, ছিনতাই, ধর্ষণ, র?্যাগিং, গেস্টরুমে নির্যাতন, শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক মিছিল-মিটিংয়ে নিয়ে যাওয়া, মাদকের সরবরাহসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের অভিযোগ। যে কারণে সংবাদমাধ্যমে টপ শিরোনাম হয়ে আসছে ছাত্রলীগ। ২০১৯ সালে ফেসবুকে ভারতবিরোধী পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে হত্যাকান্ডের পর ছাত্রলীগ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয় ছাত্রসমাজে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিল-মিটিংয়ে উপস্থিত না হলে তাদের জামায়াত-শিবির ট্যাগ দেওয়া ছাত্রলীগের এখন সাধারণ ঘটনা। এমনকি হিন্দু শিক্ষার্থীদেরও জামায়াত-শিবির ট্যাগ দেওয়ার ঘটনা ছাত্রলীগে অহরহ। শুধু তা-ই নয়, নিজেদের মধ্যে মতের অমিল দেখা দিলে ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ নেতা বা কর্মীকেও জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিতে দ্বিধাবোধ করে না প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগ নেতারা। বর্তমানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাঝে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বাস্তবায়নের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল মনোভাব বেশি। ছাত্রলীগের নতুন কমিটিগুলোতে মেধাবীদের চেয়ে অছাত্র ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত নেতাকর্মীরা পদ দেওয়া ইতিবাচকভাবে দেখছে না ছাত্রসমাজ। এভাবে যদি স্বাধীনতা পক্ষের সংগঠন ছাত্রলীগের মধ্যে শৃঙ্খলাহীন অবস্থা চলতে থাকে তবে দেশবিরোধী ও মৌলবাদী শক্তিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মোড়কে যদি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে হীন কর্মকান্ড থেকে বিরত না হয় বা সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা যদি ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে ছাত্রসমাজ থেকে ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা হারাবে। শুধু তাই নয়, ছাত্রলীগ যদি জনপ্রিয়তা হারায়- তবে বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির বিপর্যয় ঘটবে এবং বিদেশি, স্বাধীনতাবিরোধী ও মৌলবাদী শক্তিগুলো বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলাদেশে শিকড় গেড়ে বসবে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য স্বাধীনতা পক্ষের ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর উচিত তাদের প্রতিটি নেতাকর্মীদের আদর্শের সঠিক জ্ঞানের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। আদর্শবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য কঠোর সাংগঠনিক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। তবেই স্বার্থান্বেষী মহলগুলো ছাত্ররাজনীতিকে ছাত্র সমাজের প্রতি বিষিয়ে তুলতে পারবে না। পরিশেষে ছাত্ররাজনীতি হোক দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে নিত্যনতুন আবিষ্কারের মাধ্যম- যা বিশ্বের মাঝে অনন্য নজির স্থাপন করার। তবেই শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতিকে বরণ করে নেবে, ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবে।

শেখ সাদী ভূঁইয়া : নবীন লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে