বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এ বছর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় নতুন একটি রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তী সময়ে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলটির সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ।
১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচু্যত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
ওই বছরের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এর মধ্যে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' পেয়েছিল ১৪৩টি আসন।
২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু'বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল।
পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দলে ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রম্নয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তির ঘটনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘসময় এই দলটি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে জনগণের মধ্যে আস্থার স্থান তৈরি করে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেন বঙ্গবন্ধু, যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ নামে অভিহিত করা হয়। ছয় দফার ভিত্তিতেই '৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।
এরপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বিশ্ব মানচিত্রে অভু্যদয় ঘটে বাংলাদেশের।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তারপরেও কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে পারেনি এবং কোনো দিনই পারবেও না।
সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতির রায় মেনে নিতে চায়নি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 'যার হাতে যা আছে, তাই নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা'র আহ্বানে জানান তিনি। ঘোষণা দেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' বাঙালির বুকে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বোনা হয়ে যায় সেই দিনই। সেদিন থেকে আর বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। আর সে কারণেই ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে বাঙালি নিধন শুরু হলেও রুখে দাঁড়াতে সময় নেয়নি বীর বাঙালি। ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয় সমগ্র জাতি।
বাঙালি জাতি যে এক উপনিবেশ থেকে আরেক উপনিবেশের শোষণে পড়েছিল, সেটা ১৯৪৭ সালেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে চায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এটাও স্পষ্ট হয়ে যায়। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতিকে একটু একটু করে প্রস্তুত করতে হয়েছে। একদিনে হুট করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে নেমে যায়নি জাতি। এ জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভেতর দিয়েই জাতি পেয়ে যায় দিকনির্দেশনা। সেদিনই স্থির হয়ে যায় বাঙালির ভাগ্য। পাকিস্তানি শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্তির পথ যেন খুঁজে পায় বাঙালি জাতি, যার ফলে, আমরা দেখি একাত্তরে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরই যেন হয়ে উঠেছিল একেকটি দুর্গ। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কাউকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দেশকে শত্রম্নমুক্ত করার প্রত্যয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল বাঙালি। স্বীকার করতে হয়েছিল অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা।
বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। পাঁচ হাজার বছর আগেও এ ভূখন্ডের অধিবাসীদের বীরত্ব সম্পর্কে সমীহ করা হতো। মহাবীর আলেকজান্ডারের সঙ্গীরা এই বীর জাতির শৌর্যবীর্যের প্রশংসা করেছেন। আড়াই হাজার বছর আগে রোমান কবি ভার্জিলের কবিতায় গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অধিবাসীদের বীরবন্দনা প্রকাশ পেয়েছে। সেই প্রাচীনকালে বাঙালি বীর বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় করে দূরদেশেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের কৃতিত্ব দেখান। তারপরও বলা যায়, ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা এ ভূখন্ডের মানুষের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। এ দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য বিদেশি হানাদাররা বারবার আঘাত হেনেছে। বৈদেশিক আধিপত্যে একপর্যায়ে বাঙালি তার স্বকীয় মর্যাদাও হারিয়ে ফেলে।
বাঙালি মুসলমানদের অগ্রণী ভূমিকায় ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও শুরুতেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও বুড়িগঙ্গা পাড়ের মানুষ। সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানিরাই এ দেশের ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠে। শোষণ ও নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় বাঙালিরা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালির সাহসী নেতা বঙ্গবন্ধু।
১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হলে পাকিস্তানিরা তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। শুধু তাই নয়, তারা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় গণহত্যা। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। জাতি এ বছর একাত্তরের মহান বিজয়ের ৫১তম বার্ষিকী পালন করছে। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। তার সুযোগ্য কন্যার হাত ধরে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নির্মাণ, সমুদ্র সীমানা বিজয়, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, ফ্লাইওভার নির্মাণ, জেলেদের খাদ্য সহায়তা প্রদান, দারিদ্র্যতার হার নিম্ন পর্যায়ে, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, বিনামূল্যে প্রতিটি শিক্ষার্থীদের হাতে বই বিতরণ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, বিদু্যৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি, গরিব শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন ব্যবস্থা, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎ কেন্দ্র, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা প্রদান, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল তথ্য সেবাকেন্দ্র, বিভিন্ন জেলায় বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ, বিভিন্ন জেলায় শিল্পপার্ক নির্মাণ, দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকোনমিক জোন নির্মাণ, গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও কালভার্ট নির্মাণ, মোবাইল ও ইন্টারনেট গ্রাহক বৃদ্ধি, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, কৃষিতে সফলতা, জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে সফলতা, এশিয়া হাইওয়ে রোড প্রকল্প, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন, বিধবা ভাতা প্রদান, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি, বয়স্ক ভাতা প্রদান, মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান, ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যকর, মেট্রোরেল প্রকল্প, হাতিরঝিল প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেস প্রকল্প, মাদক নিধন, ভিক্ষুক মুক্তকরণ, অসংখ্য প্রাইমারি স্কুল সরকারিকরণ শেখ হাসিনা সরকারের বড় অবদান।
দয়াল কুমার বড়ুয়া : সভাপতি, চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরা, ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি