গত ০৯ ডিসেম্বর দেশব্যাপী পালিত হয়েছে 'বেগম রোকেয়া দিবস'। আর সেই সঙ্গে শেষ হলো 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ'। বছরের একদম শেষপ্রান্তে এসে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গোটা বছর জুড়েই ছিল নারীদের প্রতি সহিংসতার অজস্র ঘটনা! কেবল নারী নয়, সহিংসতার হাত থেকে রেহাই পায়নি কোমলমতি কন্যাশিশুরাও! আমাদের দেশে শক্তিশালী আইন থাকা সত্ত্বেও থামছে না নারীর প্রতি সহিংসতা। এমনকি অনলাইন দুনিয়ায়ও অবাধে ঘটছে সাইবার অপরাধ কিংবা নারী হয়রানির মতো জঘন্য সব ঘটনা!
বর্তমান সমাজে অনেক পুরুষই নারীকে দুর্বল ভাবেন। এমন অনেকেই আছেন যারা এই বক্তব্যকে যথার্থ মনে করেন আবার অনেকে একেবারেই সমর্থন করেন না। তবে নারী কিন্তু 'বহুরূপী'! একজন নারী তার জীবনে একেক বয়স ও সময়কালে একেক রূপে আবির্ভূত হন! কখনো কন্যা, কখনো জায়া আর কখনো বা জননী। বিধাতা নারীকে বিশেষ এই 'বহুরূপী' অবয়ব দিয়েই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। অথচ সেই নারী সমাজ আজ নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, সহিংসতার 'বলি' হচ্ছে! পুরুষদের নির্দয়, আগ্রাসী মনোভাবের কারণেই নারীদের গুণতে হচ্ছে কড়া মাশুল! আজকাল ঘরে, কর্মক্ষেত্রে এমনকি ব্যবসায় নারীদের জয়জয়কার! পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা! সংসার সামলানো থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা, কোথাও পিছিয়ে নেই নারীরা! তারপরেও বন্ধ হচ্ছে না তাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন। প্রকৃত অর্থে, নারীর টেকসই উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত ও নিশ্চিত করতে হলে চাই, পুরুষ-শাসিত সমাজ থেকে নারীবান্ধব সমাজ বিনির্মাণ।
নারী নির্যাতন বলতে নারীদের ওপর দৈহিক, মানসিক কিংবা সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে কোনো ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতনকে বোঝানো হয়। সহজ করে বললে, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নারীরা যখন অন্যের দ্বারা জোরপূর্বক বঞ্চনার শিকার হয় কিংবা শারীরিক, যৌন ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সেই পরিস্থিতিকে নারী নির্যাতন বলে অভিহিত করা হয়। নারীর যে কোনো অধিকার খর্ব বা কেড়ে নেওয়া হলে এবং নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বিষয় তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলে বা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছানুসারে কাজ করতে বাধ্য করাও নারী নির্যাতনের আওতায় পড়ে।
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বা নারী নির্যাতন সমগ্র পৃথিবী জুড়েই এক ভয়ানক সমস্যা! বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এই ধরনের সহিংসতা একদিকে যেমন নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, অন্যদিকে, তা পরিবার, সন্তানাদি এবং অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায়, ঘরে-বাইরে কিংবা কর্মক্ষেত্রে কোথাও নারীরা আজ নিরাপদ নয়। সব জায়গায় নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করলে ক্ষেত্র বিশেষে তাদের প্রাণ পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। এসব ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে!
এহেন ভয়ংকর অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ, পারিবারিক সুশিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি যুবসমাজকে নিয়মিত সাংস্কৃতিক, সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পুরুষদের অবশ্যই নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। জীবনে চলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে, যেমন ঘরে কিংবা কর্মস্থলে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ দেখানো একান্ত আবশ্যক। চাকরি অথবা ব্যবসায় নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা শত্রম্ন না ভেবে, অগ্রগামী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে সহযোদ্ধার ন্যায় গণ্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে, 'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর'।
আসিফ আল মাহমুদ : ফ্রিল্যান্স রাইটার, নবীন কলাম লেখক