অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে পথে-ঘাটে, পাড়া-মহলস্নায়, অলিগলির হোটেল রেস্তোঁরায়, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে, রাজনৈতিক আড্ডায় সংবিধান সম্পর্কিত ব্যাপক আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে মনে হচ্ছে, দেশ সংবিধান বিশেষজ্ঞে সয়লাব হয়ে গেছে। আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের চুম্বক কথা সংবিধান সংশোধন না পুনর্লিখন। সংবিধান জনগণের সম্পত্তি, সংবিধান জনগণের জন্য। এ কারণে সংবিধান নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হতে পারে, পরামর্শ থাকতে পারে। চলমান সংবিধান বাতিল না সংশোধন সিদ্ধান্ত নিতে চলমান সংবিধান দেশের জনগণ চাইছে কিনা, সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম কিনা, অসামঞ্জস্য বা গোঁজামিলের দোষেদুষ্ট কিনা- এ বিষয়গুলোই বিবেচ্য হওয়া উচিত। দেশের জনগণ না চাইলে, সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম না হলে, অসামঞ্জস্য বা গোঁজামিলের দোষেদুষ্ট হলে সে সংবিধান রাখার কোনো যুক্তি থাকে না। সংবিধান পুনর্লিখন/সংশোধন বিষয়ে পরামর্শ, মতামতে আবেগ, রাজনৈতিক হীনস্বার্থের দুরভিসন্ধি থাকা উচিত নয়।
চলমান সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণীত। এ সংবিধান প্রণয়নের পরপরই বিতর্কের উদ্রেক করেছে, বাতিলের দাবি উঠেছে। বিদ্যমান সংবিধান ('৭২এর সংবিধান) প্রণয়ন করেছেন গণপরিষদ সদস্যরা। '৭২-এ প্রণীত সংবিধান নিয়ে গণপরিষদ সদস্যদের মধ্যেও ঐকমত্য ছিল না। '৭২-এর সংবিধানের বিরোধিতা করে গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবিধানে স্বাক্ষর দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত '৭২-এর সংবিধানকে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে হত্যার দোষেদুষ্ট আখ্যায়িত করে বলেছেন, এমন অগণতান্ত্রিক বিধান পৃথিবীর কোনো সংবিধানে নেই। ২০১২ সালে এক গোলটেবিল আলোচনায় দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও বিশিষ্টজনরা বলেছেন, ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের অর্ধশতাধিক ধারা-উপধারা চরম ফ্যাসিবাদী। বিদ্যমান সংবিধানে চারটি মূলনীতি রয়েছে। চার মূলনীতির দুটি হচ্ছে- ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা- একই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম, সংবিধানের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় নীতিতে বেসরকারি মালিকানা বিকাশের নীতি, একমুখে পরস্পর বিরোধী কথা বলার মতো।
দুনিয়ার কোনো সংবিধানই অমর নয়। বিদ্যমান সংবিধানে ৫০টির মতো অনুচ্ছেদকে অমরত্ব দেওয়া হয়েছে। নশ্বর সংবিধানে অবিনীশ্বর অনুচ্ছেদ/ ধারা সংযোজন হাস্যকর। '৭২-এর সংবিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,'৭২-এর সংবিধান নানা দোষেদুষ্ট, বিতর্কিত। জাসদ নেতা আ স ম আব্দুর রব '৭২-এর সংবিধানকে ভারতীয় সংবিধানের ফটোকপি আখ্যায়িত করে নদীতে ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। '৭২-এর সংবিধানকে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র বলেছেন গণফোরাম নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। অনুসৃত সংবিধানকে '৭২-এর সংবিধান বলা হলেও অনুসৃত সংবিধান অবিকল ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান রয়েছে কিনা তা নিয়েও বিতর্ক আছে। ২০১১ সালে মুজিব নগর দিবস উপলক্ষ্য আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ নেতা ও ওই সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, 'বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অবিকল বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেলে আমরা ৪০ বছর পিছিয়ে যাব। আমাদের যুগোপযোগী সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে (১৭.০৪.২০১১ আমার দেশ)।' বর্তমান সংবিধান অবিকল ১৯৭২ সালের সংবিধান নয়, এ সংবিধান যুগোপযোগী নয়, যুগোপযোগী সংবিধান দরকার-এ কথাই ব্যক্ত হয়েছে মোহাম্মদ নাসিমের কথায়।
সংবিধান সময়োপযোগী না হলে, অসামঞ্জস্যতা-গোঁজামিলপূর্ণ, দল বিশেষের গঠনতন্ত্র স্বরূপ হলে সে সংবিধান রাখার কোনো যুক্তি থাকে না। চলতি সংবিধানে দেশের মালিক জনগণের আকাঙ্ক্ষার কতটা প্রতিফলন হচ্ছে, চলতি সংবিধান সময়োপযোগী কিনা বিবেচনা নিয়ে সংবিধান রাখা-না রাখার পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে। সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান তুলে দেওয়া হয়েছে। গণভোট প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণের চূড়ান্ত রায়। জনগণের চূড়ান্ত রায় দেওয়ার বিধান তুলে দেওয়ার অথোরিটি কেউ হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত বিচারপতি টমাস এস কুলি (১৮২৪-১৮৯৮)'র মতে, 'সংবিধান হচ্ছে একগুচ্ছ নিয়ম ও নীতি- যার মাধ্যমে সার্বভৌম ক্ষমতা সাধারণত কার্যকর করা হয়।' এ এক গুচ্ছ নিয়ম ও নীতি দেশের মালিক জনগণের চাওয়া। সংবিধান প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণের মালিকানা নিশ্চিতের গ্যারান্টার।
\হ'৭২-এর সংবিধান বৈষম্য দূর, জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ়করণেও ব্যর্থ হয়েছে। '৭২-এর সংবিধান হীনস্বার্থের রাজনীতি চরিতার্থে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন সময়। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণের মালিকানা নিরঙ্কুশ করবে, রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায় গিয়ে দানবে পরিণত করবে না, রাজনীতিবিদদের জনগণের সেবক হতে বাধ্য করবে, কল্যাণের রাজনীতি নিশ্চিত করবে- এমন সংবিধান জনগণের প্রত্যাশা। সংবিধান অনুমোদনের চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ দেশের মানুষ। কেউ কেউ বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের ম্যান্ডেট প্রাপ্ত নয়। সংবিধান পুনর্লিখন, সংস্কার, অনুমোদনের ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। এসব মন্তব্য কথার কথা। অন্তর্বর্তী সরকারকে ছাত্র-জনতার বিপস্নবের ফসল গণ্য করলে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের ম্যান্ডেট প্রাপ্ত নয় বলার সুযোগ থাকে না। জনগণের বৃহৎ অংশের অংশগ্রহণ ছাড়া আন্দোলন/বিপস্নব সফল হয় না। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে সংঘটিত বিপস্নবে গঠিত সরকারের জনগণের ম্যান্ডেট নেই বলা অজ্ঞতা। সংশোধিত বা পুনর্লিখিত সংবিধানের বৈধতা দেওয়ার অথোরিটি গরু খোঁজার মতো খোঁজারও দরকার নেই। সংশোধিত বা পুনর্লিখিত সংবিধান গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নিলে সর্বোচ্চ অথোরিটি দিয়েই অনুমোদিত হবে। সংশোধিত বা পুনর্লিখিত যেটাই হোক গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হলে কারো প্রশ্ন তোলার অবকাশই থাকে না। মোদ্দা কথা হলো, সংবিধান হতে হবে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ যেমন চায় তেমন।
\হ
জহির চৌধুরী : কলাম লেখক