রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

হায় বিপিএল!

তবে এত কিছুর পরও দিনশেষে বিপিএল লোকাল খেলোয়াড়দের জন্য একটা বড় আশা। তারা সারা বছর চেয়ে থাকেন এই আসরের জন্য। তাদের আয়ের একটা বড় অংশও আসে এই বিপিএল থেকে। যদিও দুঃখজনকভাবে তাদের সেই ভরসার আসরটা প্রতিবারই যেন ক্ষীণ হয়ে আসে। এই লীগের অযত্ন আর অবহেলা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, তাতে মনে হয় এটার মান আরও নিচে নামতে শুরু করবে, কিন্তু এভাবে আর কত দিন?
আজহার মাহমুদ
  ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
হায় বিপিএল!
হায় বিপিএল!

বিপিএল (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ) নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এটা আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ঘরোয়া টুর্নামেন্ট বলে কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষের এই আগ্রহকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছেন না বিসিবি। বিপিএল শুরু হওয়ার আগেই স্টেডিয়ামের বাইরে শুরু হয়েছিল মারামারি। মারামারির কারণ হচ্ছে টিকিট না পাওয়া। এরপর আরেকদিন বুথে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ক্ষুব্ধ সমর্থকরা। তাও একই কারণ, টিকিট পাচ্ছে না। প্রকৃত দর্শকরা যখন বুথে কিংবা কাউন্টারে টিকিট পায় না, তখন বাইরে কালোবাজারিরা বেশি দামে টিকিট বিক্রি করছে অনায়াসে। প্রশ্ন হচ্ছে কালোবাজারিরা টিকিট পায় কীভাবে?

বিপিএল ঢাকায় গড়িয়ে সিলেটে চলছে। চট্টগ্রামে চলবে। কিন্তু টিকিট কালোবাজারি সবখানেই চলছে ও চলবে। কারণ এখানেও আছে বড় একটি সিন্ডিকেট। যেটাতে স্বয়ং দায়িত্বশীলদেরও রয়েছে হাত। একইভাবে ব্যাংকেও টিকিট বিক্রির কথা বলেছে বিসিবি। কিন্তু সেখানেও টিকিট পাওয়া যায়নি। সেখানেও না-কি টিকিট শেষ। এই যে অব্যবস্থাপনার শুরুটা বিপিএলের টিকিটের মাধ্যমে হয়েছে সেটার শেষ কোথায় হয় সেই বিষয়টা এখন দেখার বিষয়।

টিকিটের কারণে গেট ভাঙচুর, আগুনের পর প্রেসিডেন্ট বক্সে বিসিবি প্রধানের সঙ্গে ক্রীড়া উপদেষ্টার প্রেস সচিবের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও বিপিএলে বেশ আলোচনা সৃষ্টি করেছে। পানির বুথ করার যে কাজ সেটাও বিপিএলের প্রথম দিন সম্পূর্ণ করতে না পারা এবং বিপিএল শুরু হওয়ার একদিন আগেও কেন টিকিট বিক্রির সঠিক নির্দেশনা এলো না এসব অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ক্রীড়া উপদেষ্টার প্রেস সচিব।

এতেই শেষ নয়, বিপিএল শুরুর আগে বিসিবি যেখানে বারবার বলা শুরু করেছে এটা নতুন একটা বিপিএল হবে সেই গালগল্পটা হাতেনাতে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তামিম ইকবাল। ম্যাচের আগেরদিন প্রেস কনফারেন্সে তামিম বলেছিলেন, 'আমি তো কনসার্ট ছাড়া কিছুই নতুন দেখছি না।' বিষয়টা আসলেই তেমন ছিল। তিন জেলায় তিনটি কনসার্ট করে টাকা নষ্ট না করে সেই টাকা বিপিএলের খেলায় ইনভেস্ট করলেই বেশি উপকার হতো বলে তামিমের মত ছিল। এরপর খেলার মাঝখানেই তামিম বিসিবির আরও একটি ভুল ধরিয়ে দিলেন। দর্শকদের আনন্দ দিতে এবং রান উৎসব করাতে গিয়ে বিপিএলের মাঠ ছোট করা হয়েছে। যা আন্তর্জাতিক মাঠের তুলনায় প্রায় ৫ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত ছোট করা হয়েছে। অথচ এই বিপিএল থেকেই আবার আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরি করার কথা বলে বিসিবি। যেখানে একটা মাঠ আন্তর্জাতিক মানের করে বিপিএল আয়োজন করতে পারে না, সেখানে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরি করা আষাঢ়ে গল্প ছাড়া আর কিছু নয়।

চিটাগং কিংস তাদের প্রথম খেলায় হেলমেট পরেছে কাপড় পেচিয়ে। তাদের না-কি হেলমেট আসতে দেরি হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তারা কানাডা থেকে মডেল এনেছেন হোস্ট করার জন্য এবং শহীদ আফ্রিদিকে করেছেন ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর। অথচ তারা মাঠে ভালো চারটা বিদেশি খেলাতে পারছে না। দুর্বার রাজশাহী যেন এদিক দিয়ে এককাঠি সরেস, বিপিএলে তারা মাত্র দু'জন বিদেশি দিয়ে খেলছে। কি অবস্থা দলগুলোর! ভালো বিদেশি খেলোয়াড় আনতে না পারার এই ব্যর্থতা যেমন বিপিএলের দলগুলোর আছে, তেমনি এই ব্যর্থতার দায় বিসিবিরও।

এরমধ্যে আরও একটা তথ্য রয়েছে। নতুন এই বিপিএল শুরু হওয়ার পর জানা গেছে খেলোয়াড়রা কোনো টাকা পায়নি। অথচ খেলা শুরুর আগেই অর্ধেক টাকা খেলোয়াড়দের দিতে হবে এমন নিয়ম রয়েছে। বাকি ২৫ শতাংশ খেলা চলাকালীন সময় দিতে হবে এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ খেলা শেষে পরিশোধ করার নিয়ম। অথচ এই নিয়ম মানেনি একটা ফ্র্যাঞ্চাইজিও।

যেখানে লোকাল খেলোয়াড়দের অর্থ পরিশোধ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সেখানে ভালো বিদেশি খেলোয়াড় আনবে কীভাবে! তবে এখানে আরও দুটো সমস্যা রয়েছে। এরমধ্যে একটা বেশ ভয়ংকর। খেলোয়াড়দের টাকা ফ্র্যাঞ্চাইজিরা পরিশোধ না করলে সেই টাকা বিসিবিকে দিতে হয়। তাই বিসিবি ফ্র্যাঞ্চাইজিদের কাছ থেকে প্রতিবার ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে থাকে। তবে এবারের ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে বিসিবিকে ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে শুধু বরিশাল দল। বাকি ৬টা দল সেটা করেনি। বিসিবিও এতে কর্ণপাত করেনি।

এছাড়া আরও একটি সমস্যা হচ্ছে একইসময় বিভিন্ন দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ চলে, যেমন এবার অস্ট্রেলিয়ার বিগব্যাশ, নিউজিল্যন্ডের সুপার স্ম্যাশ, সাউথ আফ্রিকার এসএ টি-টুয়েন্টি লীগ, দুবাইয়ে আইএল টি-টুয়েন্টি লীগ হচ্ছে এই বিপিএল চলাকালীন। এই লীগগুলোতে বিভিন্ন খেলোয়াড় ব্যস্ত থাকায় খেলতে পারছে না বিপিএলে। তাই বিপিএল এমন একটা সময়ে আয়োজন করা উচিত যখন খুব বেশি একটা লীগ চলবে না। তাহলে বিদেশি খেলোয়ড়দের সহজেই পাওয়া যায়।

ভালো বিদেশি খেলোয়াড় আনতে না পারাটা দিয়েই নিজেদের মেপে নিতে পারেন বিসিবি। প্রথম আসর কেমন ছিল, এরপর ধাপে ধাপে নিজেদের কতটা অধঃপতন হচ্ছে। অন্য লীগে বিদেশি খেলোয়াড়রা খেলতে পারলে আমাদের লীগে কেন আসবে না? সেই পরিমাণ অর্থ নেই? না-কি কারণটা ভিন্ন কিছু! আর অর্থের কারণেই যদি হয়ে থাকে তাহলে সেই দায়টাও নিশ্চয়ই বিসিবির। বিসিবি তেমন খেলোয়াড়দের নিলামের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতেই পারেন না। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নিজেরা যোগাযোগ করে ভালো ভালো খেলোয়াড় নিয়ে আসে। তাহলে এখানে বিসিবির ব্যর্থতা কতটা প্রকট সেটা স্পষ্ট দেখা যায়। আরও একটি বিষয় হচ্ছে, কয়েকটা ফ্র্যাঞ্চাইজি ছাড়া বাকি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কী তাহলে আর্থিকভাবে দুর্বল? বরিশাল, রংপুর যদি ভালো বিদেশি খেলোয়াড় পায়, তাহলে বাকিরা কেন পাবে না? নিজেদের এই ব্যর্থতাও স্বীকার করা উচিত ফ্র্যাঞ্চাইজিদের।

ভালো বিদেশি খেলোয়াড়ের কথা যেমন বলেছি, তেমনি কোচের কথাও বলা উচিত। এই বিপিএলে কোচদেরও যা তা অবস্থা। মানে বলা যায়, বিপিএল হওয়া উচিত এজন্য হচ্ছে।

বিপিএল নামক এই রঙ্গভরা মঞ্চটা প্রতিবছরই এমন বিনোদন দিয়ে থাকে। তাই ভক্তরা অনেকেই এটাকে বিনোদন প্রিমিয়ার লীগ বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন। এই বিপিএলে পূর্ব নির্ধারিত সূচিও পরিবর্তন হয়ে যায়, মাঠের আয়তনও ছোট হয়ে যায়, খেলার আগের দিনও দর্শক জানে না টিকিট কখন, কোথায়, কীভাবে পাবে! যাকে এককথায় বলা যায়, হ-য-ব-র-ল অবস্থা।

তবে এত কিছুর পরও দিনশেষে বিপিএল লোকাল খেলোয়াড়দের জন্য একটা বড় আশা। তারা সারা বছর চেয়ে থাকেন এই আসরের জন্য। তাদের আয়ের একটা বড় অংশও আসে এই বিপিএল থেকে। যদিও দুঃখজনকভাবে তাদের সেই ভরসার আসরটা প্রতিবারই যেন ক্ষীণ হয়ে আসে। এই লীগের অযত্ন আর অবহেলা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, তাতে মনে হয় এটার মান আরও নিচে নামতে শুরু করবে, কিন্তু এভাবে আর কত দিন?

আজহার মাহমুদ :প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে