সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

রমজানে স্বাস্থ্যকর ইফতার :সচেতনতা জরুরি

অনেক দরিদ্র মানুষ পর্যাপ্ত খাবার কিনতে সক্ষম নন, তাই সমাজের সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের উচিত অসহায় ও দুস্থ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর ইফতারের ব্যবস্থা করা। রমজান সংযমের মাস, তাই এ মাসে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।
হালিমা আক্তার হানী
  ০৬ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
রমজানে স্বাস্থ্যকর ইফতার :সচেতনতা জরুরি
রমজানে স্বাস্থ্যকর ইফতার :সচেতনতা জরুরি

রমজান মাস মুসলমানদের জন্য সংযম, আত্মশুদ্ধি, এবং ইবাদতের মাস। এ মাসে সারাদিন রোজা রেখে সন্ধ্যায় ইফতার করা হয়- যা শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে শরীরের শক্তি ও পানির ঘাটতি দেখা দেয়, তাই ইফতারের সময় এমন খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন- যা দ্রম্নত শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে এবং শরীরকে সুস্থ রাখে। কিন্তু অনেকেই ইফতারে বাইরের ভাজাপোড়া ও তেল-মশলা জাতীয় খাবার খেয়ে থাকেন- যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অতিরিক্ত তৈলাক্ত ও অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের ফলে গ্যাস্ট্রিক, হজমের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই রমজানে স্বাস্থ্যকর ইফতার গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমানে শহরাঞ্চলে অনেক মানুষ ব্যস্ততার কারণে কিংবা ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে প্রতিদিন ইফতারের জন্য বাইরের খাবার কিনে থাকেন। মেসে থাকা শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী ব্যক্তিরাও অনেক সময় রান্না করার সুযোগ পান না; ফলে, তারা বাইরে থেকে ইফতার কিনতে বাধ্য হন। রমজান মাস আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন দোকান ও রাস্তার পাশে অস্থায়ী ইফতার বিক্রেতারা বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার বিক্রি শুরু করেন। এসব খাবারের মধ্যে বেগুনি, পেঁয়াজু, চপ, সমুচা, কাবাব, পরোটা, জিলাপি, হালিম ইত্যাদি জনপ্রিয় হলেও বেশিরভাগ খাবার অস্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি করা হয়।

এ ধরনের খাবারে সাধারণত পুরনো তেল ব্যবহার করা হয়- যা ট্রান্স ফ্যাট উৎপন্ন করে এবং এটি শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বারবার ব্যবহৃত তেল ক্যানসার, হৃদরোগ এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া বাইরের খাবার অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ খোলা জায়গায় রাখা হয়, যার ফলে, তা দূষিত হয়ে যেতে পারে এবং খাদ্যজনিত রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।

অনেক খাবারে অপ্রাকৃতিক রং ও সংরক্ষণকারী রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়- যা শরীরের জন্য বিষাক্ত হতে পারে। জিলাপি, হালিম, কাবাবসহ বিভিন্ন খাবারে কৃত্রিম রং ব্যবহার করা হয়, যা লিভারের ক্ষতি করতে পারে। অতিরিক্ত তেল ও মশলাযুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে অ্যাসিডিটি, বদহজম, গ্যাস্ট্রিক ও লিভারের সমস্যা হতে পারে। তাই বাইরের ইফতারি গ্রহণের আগে অবশ্যই এসব দিক বিবেচনা করা উচিত।

রমজানে সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর ইফতার গ্রহণ করা জরুরি। সারাদিন রোজা রাখার পর এমন খাবার খেতে হবে- যা শরীরকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে এবং সহজে হজম হয়। ইফতারে এমন খাবার রাখা উচিত- যা দেহে শক্তি পুনরুদ্ধার করতে সহায়ক হবে, যেমন খেজুর, ফলমূল, দই, ছোলা, শস্যজাতীয় খাবার, পানীয় ইত্যাদি।

খেজুর ইফতারের জন্য অন্যতম উপকারী খাবার। এটি প্রাকৃতিকভাবে গস্নুকোজ ও ফাইবারসমৃদ্ধ- যা শরীরে দ্রম্নত শক্তি প্রদান করে এবং হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে। খেজুর খেলে তাৎক্ষণিক শক্তি পাওয়া যায় এবং এটি পরিপাকতন্ত্রের জন্যও উপকারী।

তরমুজ, আপেল, কমলা, কলা, পেঁপে, আঙুর, খরমুজ ইত্যাদি ফল শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ফল শরীরকে আর্দ্র রাখে, প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ সরবরাহ করে এবং হজম সহজ করে। ফলমূলে থাকা প্রাকৃতিক চিনি রক্তে শর্করার ভারসাম্য বজায় রাখে এবং পানিশূন্যতা দূর করে।

ছোলা প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং এটি দেহের পেশিশক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়ক। ছোলা ও ডালজাতীয় খাবার দীর্ঘসময় শরীরে শক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং হজমের জন্য উপকারী।

দই ও দুধ হজমে সহায়ক এবং এটি দেহের প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করে। দই গ্যাস্ট্রিক কমায় এবং অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে হজমশক্তি উন্নত করে।

সারাদিন রোজা রাখার ফলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে, তাই ইফতারে প্রচুর পানি পান করা প্রয়োজন। লেবুর শরবত, ডাবের পানি, টকদইয়ের লাচ্ছি ইত্যাদি শরীরকে আর্দ্র রাখে এবং শক্তি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।

রমজানে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা খুবই জরুরি। শুধু যারা বাইরের খাবার খান তাদের জন্যই নয়, বরং সবারই উচিত স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা। অনেক মানুষ হয়তো প্রতিদিন ফলমূল কিনতে সক্ষম নন, তবে তারা অন্তত ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পারেন। বাড়িতে তৈরি মুড়ি, ডাল, সবজি, ছোলা, দই, খেজুর ও ফলমূল ইফতার হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে- যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। রমজানে অনেকে ইফতারের সময় অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেন- যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। একসঙ্গে বেশি খেলে তা হজমের সমস্যা তৈরি করে এবং শরীরের ওপর বাড়তি চাপ ফেলে। তাই ধীরে ধীরে ও পরিমিত পরিমাণে খাবার গ্রহণ করা উচিত।

বাইরের খাবারে থাকা অতিরিক্ত তেল ও সংরক্ষণকারী রাসায়নিক শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তাই সম্ভব হলে বাসায় তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। যদি বাইরে থেকে কিনতেই হয়, তবে ভালো মানের ও পরিচ্ছন্ন খাবারের দোকান থেকে কেনা উচিত।

অনেক দরিদ্র মানুষ পর্যাপ্ত খাবার কিনতে সক্ষম নন, তাই সমাজের সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের উচিত অসহায় ও দুস্থ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর ইফতারের ব্যবস্থা করা। রমজান সংযমের মাস, তাই এ মাসে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।

রমজান শুধু ইবাদতের মাস নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শৃঙ্খলা ও সুস্থতার শিক্ষা দেয়। তাই আমাদের উচিত রমজানে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা এবং বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করা। সুস্থ শরীরেই ভালোভাবে ইবাদত করা সম্ভব, তাই পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত ইফতার গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রমজানের পবিত্রতা বজায় রেখে সচেতনতার মাধ্যমে আমরা আমাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারি এবং এই মাসের সব বরকত ও কল্যাণ লাভ করতে পারি।

হালিমা আক্তার হানী : শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে