শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২

প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও সঠিক ব্যবহারই কাম্য

সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া বাঞ্ছনীয়। খনির তেলের সুষ্ঠু আহরণে আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের গাফিলতি ও অনিয়ম-দুর্নীতি কাঙ্ক্ষিত নয়। তেলের খনির পাশাপাশি যেহেতু গ্যাসেরও সন্ধান মিলেছে। ফলে, সেখানেও স্বল্পব্যয়ে সর্বোচ্চ আহরণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।
ড. ফোরকান আলী
  ১০ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও সঠিক ব্যবহারই কাম্য
প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও সঠিক ব্যবহারই কাম্য

দেশে তেলের খনি সন্ধানের খবর স্বভাবতই আনন্দের। সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের ১০ নম্বর কূপ খনন করে প্রথম স্তরে তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এ কূপ থেকে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ ব্যারেল তেল পাওয়া যাবে। মজুত থাকা এ গ্যাস ও তেলের আর্থিক মূল্য প্রায় ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা; যদিও তেল মজুতের সম্পূর্ণ তথ্য জানতে আরও চার থেকে পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হবে।

পাশাপাশি ওই কূপের তিনটি স্তরে নতুন গ্যাসের সন্ধানও পাওয়া গেছে। সিলেট তামাবিল-জাফলং মহাসড়কের পাশে গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও ইউনিয়নের বাঘের সড়ক এলাকায় অবস্থিত এ কূপে দুই মাস আগে অনুসন্ধানের লক্ষ্যে খননকাজ শুরু করে সরকারি প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড কোম্পানি। ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর কূপটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। এ কূপে জ্বালানির মোট চারটি স্তরের সন্ধান পাওয়ার পর মজুতের বিষয়টি নিশ্চিতের জন্য আপাতত তা বন্ধ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে খনিজ তেলের আবিষ্কার অবশ্য এটাই প্রথম নয়। আশির দশকের শেষদিকে হরিপুর ফিল্ডে প্রথম তেল আবিষ্কৃত হয়। বলা বাহুল্য, বিশ্বে যখন জ্বালানি সংকট বাড়ছে, তখন নতুন আবিষ্কার হওয়া তেলের খনি আমাদের জন্য একটি সুসংবাদ। অন্তত এ তেল অভ্যন্তরীণ চাহিদার কিছুটা হলেও মেটাবে বলে আশা করা যায়। দেশে গ্যাস-বিদু্যতের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। তবে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটি সামনে রয়েছে তা হলো উত্তোলন। কারণ, এদেশে তেল-গ্যাস ক্ষেত্রগুলো একে একে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ বাঙ্গুরা গ্যাস ক্ষেত্রেও বিপর্যয়। এই ক্ষেত্র থেকে আইরিশ কোম্পানি তালেস্না গ্যাস উত্তোলন করছিল। ২০১০ সালের ৭ জুন গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। কারণ হিসেবে লাইনে বিস্ফোরণের কথা বলা হয়। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের তেল-গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চক্রান্ত চলছে। অনেক গ্যাসক্ষেত্র বন্ধ হয়ে গেছে। ছাতক, সেমুতাং, এর মতো বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলো চক্রান্তের কারণে বন্ধ হয়ে যায় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সিলেটের হরিপুরও অনেকটা চক্রান্তের শিকার। এই ক্ষেত্রটি ১৯৮৬ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। ছাতক একটি বড় গ্যাসক্ষেত্র এটির সম্ভাব্য মজুত ছিল ৪৭৩ বিলিয়ন ফুট। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয় ২৬ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ঘনফুট। উত্তোলনযোগ্য মজুত ৪৪৭ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ঘনফুট। বিদেশি কোম্পানির চক্রান্তে এটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। সেমুতাং ক্ষেত্রটিও চক্রান্তের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এটির সম্ভাব্য উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত ১৫০ বিলিয়ন ঘনফুট। বাংলাদেশে প্রচুর তেল-গ্যাস আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে এই তেল-গ্যাস নিয়ে চক্রান্ত চলছেই।

রহস্যজনক কারণে তেল-গ্যাস ক্ষেত্রগুলো বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। নিজস্ব উদ্যোগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন না বাড়িয়ে বিদেশিদের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯১০ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে তেলকূপ খননের মধ্য দিয়ে এদেশে তেল-গ্যাসের সম্ভাবনা জেগে ওঠে। ১৯১৪ সালে সীতাকুন্ডে ১৪টি কূপ খনন করা হয়। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে সিলেটের পাথরিয়ায় কূপ খনন করলে তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৫১ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকার বার্মা অয়েল কোম্পানির সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ১২টি কূপ খনন করে। ১৯৫৫ সালে এদেশে ভূতত্ত্ববিদ মরহুম আশফাক হোসেন খানের নেতৃত্বে বার্মা অয়েল কোম্পানির সাবসিডিয়ারি পাকিস্তান অয়েল পেট্রোলিয়াম লি. (পিপিএল) সর্ব প্রথম সিলেটে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। ১৯৫৬ সালে পিপিএল ছাতকে দ্বিতীয় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। ১৯৫১ সালে এদেশে সরাসরি বিদেশি কোম্পানি (আমেরিকার স্টেনভেক) তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করে। এই কোম্পানি কুচমা, বগুড়া, হাজিপুর এলাকায় ৩টি কূপ খনন করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে নেদারল্যান্ডের শেল অয়েল কোম্পানি স্থল ভাগে ১০ এবং সমুদ্র এলাকায় ১টি কূপ খনন করে। এরা ১৯৬০ সালে সিলেট, কুমিলস্না ও রশিদপুরে, ১৯৬২ সালে কৈলাশটিলা, তিতাস, ১৯৬৩ সালে হবিগঞ্জ, ১৯৬৮ সালে বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নিজস্ব কোম্পানি গঠন করে। যার নাম ছিল অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (ওজিডিসি)। এই কোম্পানি ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামের সেমুতাং এ কূপ খনন করে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ তেল-গ্যাস ও খনিজ করপোরেশন (বিওজিএমসি) নামে সংস্থা গঠন করা হয়। সেটি ১৯৭৩ সালে হয় বাংলাদেশ তেল-গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন বা পেট্রো বাংলা। ১৯৭৪ সাল থেকে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে এদেশের তেল-গ্যাস উৎপাদনে সরাসরি সম্পৃক্ত করা হয়। শুরু হয় উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিয়ন অয়েল কোম্পানি, আটলান্টিক রিচফিল্ড অয়েল কোম্পানি, এ্যাসল্যান্ড কোম্পানি, কানাডিয়ান সুপিরিয়র অয়েল কোম্পানি, সাবেক যুগোস্স্নাভিয়ার ইনানাপথাপিস্নন এবং জাপানের বেঙ্গল অয়েল ডেভেলপমেন্ট অয়েল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়।

১৯৮১ সালে আসে শেল অয়েল কোম্পানি। শুরু হয় বিদেশি কোম্পানিগুলোর তৎপরতা। কমে যায় নিজস্ব নির্ভরতা সেই সঙ্গে এদেশের তেল-গ্যাস নিয়ে চক্রান্তও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশিদের হাতে একের পর এক গ্যাসক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশে প্রচুর তেল-গ্যাস সম্পদ নিয়ন্ত্রিতভাবে উত্তোলন, নতুন করে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নিজস্ব কোনো উদ্যোগ নেই। বিদেশিদের ডেকে আনা হচ্ছে, দেশ যখন জ্বালানি সংকটে পড়েছে তখনো সরকার বিদেশিদের পিছু ছুটছে। নিজস্ব তৎপরতা বলতে কিছুই নেই। আবার প্রচুর কয়লা থাকার পরও তা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেই অজ্ঞাত কারণে। কয়লানীতি ঝুলে আছে। হালনাগাদ কোনো জ্বালানি নীতিও নেই। অথচ জ্বালানি সংকটে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে স্থবিরতা নেমে এসেছে।

এছাড়া অবহেলা ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সরকারি সম্পদ, জনগণের মালিকানাধীন প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়ের নজির অতীতে আমরা দেখেছি। গাফিলতি ও নানা অনিয়মের কারণে অতীতে দেশের অনেক সমৃদ্ধ গ্যাসক্ষেত্র সংকটের মুখে পড়েছে। আবার দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তির অভাবে বিদেশি সংস্থাকে কাজ দিয়ে লাভের অধিকাংশই তাদের হাতে তুলে দেওয়ার ইতিহাসও আছে। অন্যদিকে দেশি কোনো সংস্থাকে কাজ দিতে গেলেও প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দরপত্র আটকে যাওয়ার মতো ঘটনাও আমরা দেখেছি। এমন প্রেক্ষাপটে তেলের খনির সন্ধানের খবর আনন্দের হলেও তা উত্তোলন ও বাজারজাতের বিষয়টি সুষ্ঠু না হলে দেশের এ সম্পদ হতাশা ও নিরানন্দের কারণও হয়ে উঠতে পারে। ছোট আয়তনের দেশ হওয়ার কারণে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি সর্বজনস্বীকৃত।

এ অবস্থায় সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া বাঞ্ছনীয়। খনির তেলের সুষ্ঠু আহরণে আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের গাফিলতি ও অনিয়ম-দুর্নীতি কাঙ্ক্ষিত নয়। তেলের খনির পাশাপাশি যেহেতু গ্যাসেরও সন্ধান মিলেছে। ফলে সেখানেও স্বল্পব্যয়ে সর্বোচ্চ আহরণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, গ্যাস খাতে অতীতে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উদ্ঘাটন এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। উলেস্নখ্য, যে ভূতত্ত্ববিদ ও কারিগরি ব্যক্তিরা এ ধরনের আবিষ্কারের সঙ্গে কার্যকরভাবে জড়িত থাকেন, তাদের সমন্বয়ে কোনো কারিগরি দল গঠন করে তেলক্ষেত্রটির সার্বিক উন্নয়নের যথার্থ কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। আবিষ্কার করা একটি কূপ থেকে প্রাকৃতিকভাবে যে কয় বছর আপনা আপনি তেল বের হতে থাকে, তাতেই তেল কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকে। ওই একটি কূপ থেকে মোট তেল মজুতের অল্প অংশ এভাবে উৎপাদিত হওয়ার পর কয়েক বছরের মধ্যে তা বন্ধ হয়ে যায়। মাটির নিচে পড়ে থাকে তেলের মজুতের বড় অংশ। এটি একটি অপরিপক্ব দুর্বল ব্যবস্থাপনার সাক্ষ্য বহন করে। তেলক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য যে বৈজ্ঞানিক প্রথা প্রচলিত রয়েছে, সে অনুসারে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে তেলক্ষেত্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এটি ঘটেছে ইতোপূর্বে আবিষ্কৃত বাংলাদেশের প্রথম তেলক্ষেত্র হরিপুরে। প্রশ্ন হলো, এবারো কি নতুন এই তেলক্ষেত্রে তা-ই ঘটবে? এ অবস্থায় অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সরকার প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ ও এর সঠিক ব্যবহারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এটাই প্রত্যাশা।

ড. ফোরকান আলী : গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে