সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

পুঠিয়া রাজবাড়ী

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ০২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

পুঠিয়া রাজশাহী জেলার একটি উপজেলা। এ উপজেলায় পুঠিয়া রাজবাড়ী অবস্থিত। রাজশাহী শহর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার পূর্বে এবং রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে এই রাজবাড়ীটির অবস্থান।

পুঠিয়া জমিদারির সতেরো শতকের প্রথমদিকে মুঘলদের সৃষ্ট বাংলার প্রাচীনতম জমিদারিগুলোর অন্যতম।

পুঠিয়ার জমিদারি মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে 'রানী হেমন্তকুমারী দেবী' এই রাজবাড়ী তৈরি করেছিলেন। পুঠিয়া রাজবাড়ী বা পাঁচআনি জমিদারবাড়ি হচ্ছে মহারানী হেমন্তকুমারী দেবীর বাসভবন।

বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের মধ্যে রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ী অন্যতম। ১৮৯৫ সালে মহারানী হেমন্তকুমারী দেবী আকর্ষণীয় ইন্দো ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে আয়তাকার দ্বিতল রাজবাড়ীটি নির্মাণ করেন।

এই রাজবাড়ীটি পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। পরিখাগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- শিব সরোবর বা শিবসাগর, গোপালচৌকি, বেকিচৌকি, গোবিন্দ সরোবর ও মরাচৌকি। এছাড়া রাজবাড়ী এলাকার মধ্যস্থলে রয়েছে শ্যামসাগর নামে একটি বিশাল পুষ্করিণী।

জনশ্রম্নতি আছে যে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের (১৬০৫-১৬২৭) নিকট থেকে নীলাম্বর 'রাজা' উপাধি লাভ করেন। ১৭৪৪ সালে জমিদারি স্বত্ব ভাগাভাগি হলে জ্যেষ্ঠ শরিক সাড়ে পাঁচ আনা এবং অপরাপর ৩ শরিকের প্রত্যেকে সাড়ে তিন আনা অংশের মালিক হন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পাকিস্তান এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্টের অধীনে জমিদারি বিলুপ্তির পূর্ব পর্যন্ত পুঠিয়ার জমিদারি অক্ষুণ্ন ছিল।

সপ্তদশ শতকে মুগল আমলে তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পুঠিয়া জমিদারি ছিল প্রাচীনতম। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত জমিদারি প্রথা ছিল। প্রথা বিলুপ্ত হলে পুঠিয়া রাজবাড়ীর জমিদারিও বিলুপ্ত হয়। কিন্তু জমিদারি বিলুপ্ত হলেও সে আমলে নির্মিত তাদের প্রাসাদ, মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা এখনো টিকে রয়েছে। এ প্রাসাদটি ১৮৯৫ সালে মহারানী হেমন্তকুমারী দেবী তার শাশুড়ি মহারানী শরৎ সুন্দরী দেবীর সম্মানে নির্মাণ করান।

ভবনের সম্মুখ ভাগের স্তম্ভ, অলংকরন, কাঠের কাজ, কক্ষের দেয়ালে ও দরজার উপর ফুল ও লতাপাতার চিত্রকর্ম চমৎকার নির্মাণ শৈলীর পরিচয় বহন করে। রাজবাড়ীর ছাদ সমতল, ছাদে লোহার বীম, কাঠের বর্গা এবং টালি ব্যবহৃত হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য রাজবাড়ীর চারপাশে পরিখা খনন করা হয়েছিল।

পুঠিয়া রাজবাড়ীর আশপাশে ছয়টি রাজদীঘি আছে। প্রত্যেকটা দীঘির আয়তন ছয় একর করে। মন্দিরও আছে ছয়টি। সবচেয়ে বড় শিবমন্দির। এ ছাড়া আছে রাঁধাগোবিন্দ মন্দির, গোপাল মন্দির, গোবিন্দ মন্দির, দোলমঞ্চ ইত্যাদি। প্রতিটি মন্দিরের দেয়ালেই অপূর্ব সব পোড়ামাটির ফলকের কারুকাজ। জোড়বাংলা মন্দির, বাংলো মন্দির, পঞ্চরত্ন অর্থাৎ চূড়াবিশিষ্ট মন্দির। বাংলার বিভিন্ন গড়নরীতির মন্দিরগুলোর প্রতিটিই আকর্ষণীয়। এ ছাড়া রানির স্নানের ঘাট, অন্দর মহল মিলিয়ে বিশাল রাজবাড়ী প্রাঙ্গণ।

পুঠিয়ার রাজবাড়ী ওই এলাকার সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য নিদর্শন। দোতলা রাজবাড়ী ভবনের সম্মুখে উত্তর দিকে খোলা প্রাঙ্গণের অপর পাশে রয়েছে সম্মুখভাগ ৬০.৯৬ মিটার বিস্তৃত বিশাল পিরামিড আকৃতির চারতলা মনোরম দোলমঞ্চ। ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে একই ধরনের দুটি সম্প্রসারিত অংশ এবং প্রায় ১৫.২৪ মিটার দীর্ঘ মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে এক বিশাল তোরণ। ইমারতের সম্মুখস্থ ৩.০৪ মিটার চওড়া একটানা বারান্দা থেকে পেছনের বিশাল হলঘরে প্রবেশের পথ রয়েছে। ঝুল বারান্দার ছাদটি দোতলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত তিনটি মাধুর্যমন্ডিত অর্ধ-করিনথিয়ান পলকাটা স্তম্ভের ওপর স্থাপিত। কেন্দ্রীয় স্তম্ভপথটির সম্মুখস্থ উপরিভাগে ত্রিকোনাকার কারুকার্যখচিত অংশ রয়েছে এবং বৈচিত্র্যময় সূক্ষ্ণ আস্তরের উদ্গত নকশা দ্বারা ছাদের বপ্র (প্যারাপেট) সুসজ্জিত করা হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম দিকের প্রান্তিক স্তম্ভপথের প্রশস্ত বারান্দাগুলো চারটি পলকাটা করিনথিয়ান স্তম্ভের ওপর স্থাপিত এবং এ স্তম্ভগুলো উপর তলার ছাদ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। রানি হেমন্তকুমারী দেবী তার শাশুড়ি মহারানী শরৎসুন্দরী দেবীর সম্মানার্থে ১৮৯৫ সালে এ বিশাল প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে লস্করপুর ডিগ্রি কলেজ এ ইমারতটি ব্যবহার করে। রাজশাহী জেলা সদর হতে ৩২ কি.মি. উত্তর-পূর্বে নাটোর মহাসড়ক অভিমুখে বাঘা-পুঠিয়া জেলা সড়কের পাশে এটি অবস্থিত। বাসে করে দেশের যে কোনো স্থান হতে পুঠিয়া আসা যায় এবং ট্রেনে করে নাটোর অথবা রাজশাহী নেমেও সড়কপথে সহজে আসা যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে