শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

কনসার্টের মৌসুমেও শিল্পীরা বেকার

মাতিয়ার রাফায়েল
  ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
কনসার্টের মৌসুমেও শিল্পীরা বেকার
কনসার্টের মৌসুমেও শিল্পীরা বেকার

ইউরোপ-আমেরিকা তথা পশ্চিমা দেশগুলোয় কনসার্ট জমে গ্রীষ্মকালে, আর বাংলাদেশে শীতে। চাদর আর গরম জামা জড়ানো হুড়মুড়িয়ে শীত (পৌষ ও মাঘ) নামার আগেই কার্তিকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কনসার্টের হিড়িক পড়ে। ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরা (আইসিসিবি), আলোকি, কেআইবি কমপেস্নক্সে কান পাতলেই ভেসে আসে গিটারের টুংটাং, ড্রামসের দ্রিম দ্রিম দ্রিমিকি ধ্বনি আর রক গানের উন্মাতাল সুর।

নভেম্বর থেকে জানুয়ারি, বছর শেষ এবং বছর শুরু মিলিয়ে এই তিনি মাস হচ্ছে কনসার্টের পিক টাইম। প্রতি বছরই এটা একটা অলিখিত নিয়মই হয়ে আসছে দেশজুড়ে। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এমন মৌসুমে গা গরম করা উন্মাতাল কনসার্ট হবে না- তা কী করে হয়! তবে এবার যে গা গরম করানো সেই কনসার্টে বেশ ভালোই ভাটা পড়তে যাচ্ছে সেটা নভেম্বরের শুরু থেকেই যেন জানান দিয়ে রাখল। এবারের শীত মৌসুম বরাবরের মতো কনসার্ট দিয়ে গা গরম হচ্ছে না। এবার নভেম্বর থেকে জানুয়ারি- গোটা তিন মাসই মানুষের গা গরম থাকবে নির্বাচনী ডামাঢোল পিটানো গরম চা গেলা আনন্দ উৎসবের মধ্যদিয়ে। নির্বাচনী স্স্নোগানের গানে-গানে মাঠ গরম হয়ে উঠবে এবারের শীত, কনসার্টের মৌসুম।

এমনটিই বলছেন এখন কনসার্টের শিল্পীরা। তারা বলছেন, একদিকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা অন্যদিকে তার প্রতিরোধে হরতাল-অবরোধ- এই দুই বৈরী পরিবেশের কারণে এবার প্রতি বছরের মতো আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে আর উন্মুক্ত স্টেজশো হচ্ছে না। উন্মুক্ত কনসার্টও হচ্ছে না। অর্থাৎ এবারের গানের মৌসুমটা বেকারই থাকতে হবে বহু গানের শিল্পীদের। যারা তাদের সারা বছরের আয়-রোজগার এই তিন মাসেই করে থাকেন। যে আয় দিয়ে তাদের বছরের বাকি মাসগুলো কেটে যায়।

এবার উলেস্নখযোগ্য কনসার্ট বলতে গেলে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ২০ অক্টোবর তথা কার্তিকে হওয়া 'চলো বাংলাদেশ' শিরোনামে কনসার্টটিই ছিল সাড়া জাগানো। এটা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে। ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এ কনসার্টে গান পরিবেশন করেন ব্যান্ডদল আর্টসেল, ক্রিপ্টিক ফেইট, নেমেসিস, রাফা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস, ওয়ারফেজ এবং পান্থ কানাই, হাসান, হাবিব ওয়াহিদসহ আরও অনেকে। দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড ও শিল্পীদের নিয়ে এই কনসার্টের আয়োজন করেছিল তখন বহুজাতিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন।

গেল অক্টোবরে আরও বেশকিছু কনসার্টের আয়োজন হয়েছিল ইনডোর এবং আউটডোর মিলিয়ে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য খামারবাড়ীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ মিলনায়তনে 'নচিকেতা লাইভ ইন ঢাকা উইথ জয় শাহরিয়ার' কনসার্ট। এতে পারফর্ম করেন ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী। এ ছাড়া কার্তিকে হওয়া গুলশানে পেন্টাগন ব্যান্ডের তিন দশক পূর্তি পালন করা হয়। ওই একই মাসে রক ব্যান্ড সাবকনশাসের রজতজয়ন্তীতে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজিত কনসার্টেও শ্রোতাদের সরব উপস্থিতি ছিল। এসব কনসার্টে ওয়ারফেজ, আর্টসেল, শিরোনামহীন, ক্রিপটিক ফেইটের মতো জনপ্রিয় ব্যান্ডকে পাওয়া গেছে। 'চলো বাংলাদেশ কনসার্ট', 'রক ইন দ্য সিটি' কনসার্টে রক ও পপগানে অনুরণন তুলেছেন ঢাকার ব্যান্ড ও শিল্পীরা। বেশিরভাগ কনসার্টেই শ্রোতাদের উপচে পড়া ভিড় ছিল, হালকা শীতের সন্ধ্যায় গানের তালে নাচতেও দেখা গেছে শ্রোতাদের।

এরপর অগ্রহায়ন বা নভেম্বর আসার পর থেকে সেই চিরাচরিত চিত্রের সবকিছুই যেন কেমন থমকে আছে। কনসার্ট হচ্ছে না তেমন একটা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বেশিরভাগ কনসার্টের আয়োজন করা হচ্ছিল ইনডোরে। ইনডোরে আয়োজিত কনসার্টগুলো আবার গণমাধ্যমে আলোচনাও হয় কম। সে তুলনায় আলোচিত হওয়ার মতো উন্মুক্ত কনসার্ট খুব কমই হয়েছে।

কার্তিকের শেষ সপ্তাহেও ঢাকায় বেশ কয়টি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ছিল আর্মি স্টেডিয়ামে 'কোক স্টুডিও বাংলা লাইভ'। ওই কনসার্টে পারফর্ম করেছেন মমতাজ বেগম, বাপ্পা মজুমদার, ফুয়াদ আল মুক্তাদির, শায়ান চৌধুরী অর্ণব, পান্থ কানাই, ইমন চৌধুরী, ঋতু রাজ, নন্দিতা, সুনিধি নায়েক, আরমীন মুসা, ঈশানসহ প্রায় শতাধিক শিল্পী। অন্যদিকে গত কার্তিকে রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) মিলনায়তনে 'আইবিএ রক নাইট' কনসার্টে নেমেসিস, সোনার বাংলা সার্কাসসহ চারটি ব্যান্ড পারফর্ম করে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে 'হায়েনা এক্সপ্রেস এক্সপেরিয়েন্স'-এ পাওয়া গেছে সোনার বাংলা সার্কাসকে।

কার্তিক মাসজুড়ে ঢাকার বাইরে সিলেট, বগুড়া, নরসিংদী, কুমিলস্না, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কনসার্টের খবর মিললেও এরপর থেকেই কনসার্ট হওয়ার সংবাদ হওয়ার ঘটনা বলতে গেলে নেই-ই। তাই কনসার্টের এই ভরা মৌসুমেই ভাটার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের কনসার্টের জন্য সবচেয়ে উপযোগী মৌসুম শীতকাল। পৌষ ও মাঘ মাসের জন্য অপেক্ষায় থাকেন কনসার্ট আয়োজকরা। দুই মাসেই সবচেয়ে বেশি কনসার্ট করেন তারা, তবে এবার কনসার্টের ভরা মৌসুমে ভাটার শঙ্কা করছেন তারা। আবার নির্বাচনের আগে কনসার্টের অনুমতিও মিলবে কি না, তা নিয়েও অনিশ্চয়তায় রয়েছেন আয়োজকরা। অনুমতি পেলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে শ্রোতাদের খরা থাকবে। তা ছাড়া এরই মধ্যে আগামী বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতার (হরতাল, অবরোধ) মধ্যে নভেম্বরের শেষ ভাগে ও ডিসেম্বরে বেশ কয়েকটি কনসার্ট বাতিল করেছেন আয়োজকরা।

তবে এই ভাটার টানেও সর্বশেষ চলতি মাসের নভেম্বরের শেষে ২৪ তারিখ রাজধানীর হাতিরঝিল এম্ফিথিয়েটারে ফিলিস্তিনের গাজাবাসীদের সাহায্যার্থে 'টু গাজা ফ্রম ঢাকা' শিরোনামে অবাণিজ্যিক চ্যারিটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল। এটা প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক পরিবেশের কারণসহ কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে সেই ভেনু্য স্থানান্তর করে হাতিরঝিলের এম্ফিথিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। এই কনসার্টে ২০টির মতো ব্যান্ড ও সঙ্গীতশিল্পী গান পরিবেশন করেন। 'আর্টিস্ট অ্যাগেইনস্ট জেনোসাইড' এর ব্যানারে আয়োজিত এই কনসার্টে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মাকসুদ ও ঢাকা, নেমেসিস ব্যান্ডের জোয়াদ রেজা চৌধুরী, কার্নিভাল, মাশা ইসলাম,র্ যাপার সাফায়েত, আসির আরমান প্রমুখ। আয়োজকরা বলেছেন, ব্যান্ড ও শিল্পীরা কেউই কোনো পারিশ্রমিক নেননি। সম্পূর্ণ মানবিক কারণেই তারা এই কনসার্টে অংশগ্রহণ করেছেন। এই কনসার্ট থেকে প্রাপ্ত অর্থের পুরোটাই গাজাবাসীদের জন্য পাঠানোর উদ্দেশ্যেই আয়োজকরা এই মহতী উদ্যোগ নেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে