শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

একই বৃত্তে বন্দি ওটিটি

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
গুটি ওয়েব সিরিজের একটি দৃশ্যে আজমেরী হক বাঁধন

শোবিজ মানেই যেখানে সমুদ্রের মতো অপার সৃজনশীলতার সুযোগ থাকবে, ধারাবাহিকভাবে হওয়া এমন কন্টেন্টের অসীমত্ব। কিন্তু বর্তমানে শোবিজের প্রতিটি শাখাতেই সৃজনশীলতার জন্য একটি বড় সংকট দেখা দিয়েছে। হোক সেটা সিনেমায়, নাটক, কিংবা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হোক। শেবিজের সৃজনশীলতায় যখন এমনই ঘাটতি দেখা দিচ্ছিল, প্রচলিত পস্ন্যাটফর্মগুলোতে একের পর এক কন্টেন্টে তখন সর্বশেষ আসে বাইরে থেকে আমদানি করা ওটিটি (ওভারদ্য টপ) পস্ন্যাটফর্মের কন্টেন্ট নির্ভর আইডিয়া।

শুরুতে অবশ্য অতিউৎসাহী কিছু তরুণ পরিচালকের হাত ধরে আসে সুরসুরি দেওয়া কন্টেন্ট। যে কারণে সম্ভাবনাময় এই পস্ন্যাটফর্মটি অঙ্কুরেই রসাতলে যাচ্ছিল। প্রাইমারি টাইমের নির্মাতাদের কাছে ওটিটি কন্টেন্ট মানেই ছিল সুরসুরি দেওয়া কিছু রগরগে মালমসলার দৃশ্যায়ন। সহজ কথায় রসময় গুপ্ত'র চটিবইয়ের কন্টেন্টই ছিল তাদের রাতারিতা আলোচনায় আসার খোরাক। মানুষের বাস্তব জীবনে এর চেয়ে 'বাস্তব' আর কিছুই নেই- সেটা দেখানোই ছিল প্রথম ওটিটি কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের সাধনা। কিন্তু তারা ভুলে যান যে, ওসব যৌনজীবন নিয়ে খুব বেশি কন্টেন্ট হয় না। ঘুরে-ফিরে সব একই বিষয়ই চলে আসে। তখন দর্শকের কাছেও সেটা বিরক্তিকর বা বোরিং হয়ে ওঠে। আর সেটাই হয়েছে। দর্শক তাদের ওই কন্টেন্ট আর নিতে চায়নি। বরং এর প্রতিবাদে একপর্যায়ে এ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা পর্যন্ত গড়ায়।

এরপরই আসে ওটিটিতে নতুন পরিবর্তন। এই পরিবর্তিত সময় ওটিটিতে আসে সমাজ ও রাষ্ট্রে থাকা ক্রাইম, পুলিশ, মাদক, অপহরণসহ নানা অপরাধের আখ্যান নিয়ে কন্টেন্ট। অর্থাৎ যেগুলো 'অতি কল্পনা'র জাদুকরী বিষয়-বস্তু ছাড়া কিছুই না। প্রথমে এটা দর্শকের কাছে বেশ মনে ধরে এবং দ্রম্নতই এটা দর্শকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠে। তবে এই কন্টেন্টগুলোতে যারা পারফর্ম করেন, তারা সবাই ছোটপর্দার আলোচিত তারকারাই। অর্থাৎ এক ছোটপর্দা থেকে আরেক ছোটপর্দায় যাওয়া বড় তারকাদের নিয়ে বানানো কন্টেন্টই হয়ে ওঠে ওটিটি ক্রিয়েটরদের মূল ভরসার জায়গা। কিন্তু এই ওটিটি কন্টেন্ট এমন নয় যে, তারা নতুন অপরিচিত স্বতন্ত্র শিল্পীদের নিয়ে তাদের কন্টেন্টে জোয়ার আনতে পেরেছেন। চলচ্চিত্র যেমন একেবারে নতুন নায়ক-নায়িকা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, ওটিটি ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেনি। সবাই ছোটপর্দার জনপ্রিয় চেনামুখগুলোই। এখন ওটিটির কিছু কন্টেন্ট যে জনপ্রিয় হয়েছে, সেটা কি ওটিটি কন্টেন্টের জন্য নাকি টিভি পর্দার জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীর জন্যই এটাও বড় তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার।

তবে এভাবে যে ওটিটি কন্টেন্ট বেশিদূর অগ্রসর হতে পারবে না, সেটা ইতোমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। কারণ, তারা যেসব কন্টেন্ট নিয়ে আসছে এতে সেই সবই একই বিষয়ে ঘুরেফিরে আসছে। সেই মাদক, পুলিশ, ক্রাইম, অপরাধ, হরর, থ্রিলার- এগুলোই ঘুরে ফিরে আসছে। আবার পুলিশ, ক্রাইম, হরর, থ্রিলারের সঙ্গে থাকা অতিকল্পনামতো রোমাঞ্চ যেমন কাহিনীর বয়ানের মুন্সিয়ানার মধ্যে ফুটে ওঠে, তেমনি এতে যদি কিছু যৌনদৃশ্য থাকে তখন তো এতে আপনাআপনিই রোমাঞ্চ দুলে ওঠে। তখন এসব কন্টেন্টে প্রেম যতটা গুরুত্ব পায়, এর চেয়ে বেশি যৌন সম্পর্কের রোমাঞ্চই বেশি গুরুত্ব পায়। অর্থাৎ এতে প্রেমও এসেছে সেই থ্রিলমতোই যৌনাত্মকভাবে। তখন পুলিশ, ক্রাইম, হরর ও থ্রিলারের সঙ্গে যৌনানুভূতিকর দৃশ্যায়নও একাকার হয়ে যায়।

এরই ধারাবাহিকতায় করোনাকালীন গত দুই বছরে বেশ কয়েকজন নব উদ্যমশীল তরুণ পরিচালকের দেখা মেলে। যারা সবাই এর আগে নাটক-টেলিফিল্ম-শর্টফিল্ম বানাতেন। যারা ওটিটি মানেই ওই 'এরকম কিছু জাতীয়' কন্টেন্ট নিয়ে দর্শক মাতিয়ে রাখছেন তারা হচ্ছেন মোস্তফা সারয়ার ফারুকী, আশফাক নিপুণ, মিজানুর রহমান আরিয়ান, রেদওয়ান রনি, ভিকি জাহেদ, সৈয়দ আহমেদ শাওকী প্রমুখ।

কিন্তু মানুষের একটি পৃথিবীতে ও রাষ্ট্রে যে এগুলোই সব না- যারা এসব কন্টেন্ট দেখেন, তারা নিজেরাও বুঝতে পারেন। কেননা, নিশ্চয় এই দর্শকের সবাই ক্রাইম, পুলিশ, মাদক ও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয়। কাজেই তারা যে জীবনযাপনে সময় পার করে, সেগুলোর মধ্য দিয়েই যদি তারা নিজেকে দেখতে না পায়, তাহলে এই একই গন্ডিতে আবদ্ধ এসব কন্টেন্ট বারবার ঘুরেফিরে দেখবে কেন? শুধু শুধু ওই ছোটপর্দার তারকা শিল্পীদের পয়সা দিয়ে দেখার জন্য? দর্শক কি এতটাই নির্বোধ হয়ে গেছে যে, শুধু শুধু টাকা খরচ করে ওটিটি দেখার নামে তারকা শিল্পী দেখবে?

কিন্তু প্রায় সব কন্টেন্টেই ঘুরেফিরে একই তারকা শিল্পীই বা কয়দিন ভালো লাগে। প্রথম প্রথম অবশ্য দর্শক তাদের প্রিয় তারকা শিল্পীর অভিনয় দেখার জন্য ওয়েবসিরিজ বা ওয়েবফিল্ম দেখতে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছিল। তাদের এই আগ্রহ দেখে একে একে বেড়েছিল ওটিটি পস্ন্যাটফর্মও। এরই ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত ১৪টি ওটিটি পস্ন্যাটফর্ম হয়ে গেছে। বঙ্গ, চরকি, টফি, বিঞ্জ, টেলিফিক্স, বাংলাফিক্স, আইফ্লিক্স, জাগোবিডি, আড্ডাটাইমস, বাইস্কোপ, র?্যাবিটহোলবিডি, রবিটিভি, সিনেস্পট প্রভৃতি। সর্বশেষ চ্যানেল আইয়ের আইস্কিন। এতেই বোঝা যাচ্ছে, দেশে ওটিটির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

ওয়েবসিরিজের অনেকগুলোই দেশের দর্শককে আকৃষ্ট করেছে। এখন বিদেশের পস্ন্যাটফর্মেও এগুলো দেখানো হচ্ছে। ভারতের ওটিটি পস্ন্যাটফর্ম হইচই ও জি-ফাইভে ধারাবাহিকভাবে মুক্তি পেয়েছে 'মহানগর', 'মাইনকার চিপায়', 'বলি', 'দৌড়', 'কষ্টনীড়', 'হোয়াট দ্য ফ্রাই', 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান'।

তবে তাদের প্রত্যেকেরই কন্টেন্টগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অভিনয়, লোকেশন, দৃশ্যায়ন ও প্রোডাকশনে তারতম্য ও অভিনবত্ব থাকলেও গল্পের বিষয়গুলোর প্রায় সবই একই গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। গল্পে যতটা না সৃজনশীলতা আসছে, ততোধিক আসছে অভিনয়, লোকেশন, দৃশ্যায়ন ও প্রোডাকশনেই চমৎকৃত করার বিষয়। যাতে থাকবে অন্তত একটা জাদুকরী সংলাপ। যে সংলাপটিই শুধু আলোচনায় থাকবে। এরপর ভুলে যাবে দর্শক নিমেষেই কন্টেন্টের রহস্যগন্ধী দৃশ্যায়ন, অতিকল্পনা, অভিনয় প্রভৃতি।

তবে নির্মাতারাও যে এই একই গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ার বিষয়টি বুঝতে পারছেন না- তা নয়। সে জন্য ইতোমধ্যে কেউ ব্যতিক্রম কিছু দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে ওটিটি পস্ন্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে 'আমি কি তুমি' নামের ওয়েব সিরিজ রিলিজও হয়েছে ভিকি জাহেদের। থ্রিলার এবং হররের বাইরে রোমান্স এবং ড্রামা বেইজ কন্টেন্ট নিয়ে বানানো এই সিরিজটি যারা দেখেছেন, তারাই বলবেন এমন কন্টেন্ট তো ছোটপর্দায় হরহামেশাই কতবারই তো দেখা গেছে। তাহলে এমন একই কন্টেন্ট ওটিটিতে যদি দেখতে হয়, এটা ছোটপর্দার কন্টেন্ট থেকে আলাদা হিসেবে হলো? ছোটপর্দার বড় অভিনেত্রী মেহজাবীন তিথি চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলে? আসলে পার্থক্য তো এটাই যে, ছোটপর্দায় এমন কন্টেন্ট দেখতে টাকা লাগে না আর ওটিটি পস্ন্যাটফর্মে দেখতে হলে সাবস্ক্রাইবার হতে হয়।

ফলে এ নিয়ে দেশের বিশিষ্ট অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, 'ওটিটিতে এখন যা নির্মাণ হচ্ছে, সবই একই জিনিস থ্রিলার, হরর, পুলিশ, ক্রাইম। তবে এই ধারা থাকবে না। শিগগিরই এই একই গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে ওটিটি।' কিন্তু এই গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে তারা ছোটপর্দা ও বড়পর্দা থেকে এমন কি আলাদা কন্টেন্ট উপহার দিতে পারবে যে, পস্ন্যাটফর্ম ছোটপর্দা ও বড়পর্দা থেকে স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে