মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকাই সিনেমায় বাড়ছে উচ্চশিক্ষিত নায়িকা

মাতিয়ার রাফায়েল
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
অপি করিম, শবনম বুবলি, জ্যোতিকা জ্যোতি, জাকিয়া বারী মম

মানুষের জীবনে শিক্ষার গুণ প্রতিটি সেক্টরেই একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে। আর এরসঙ্গে যদি যুক্ত হয় 'উচ্চশিক্ষা' তাহলে তো কথাই নেই। আবার স্বশিক্ষিত হয়েও অনেকে অনেক গুণের পরিচয় দিয়ে আসছেন এমন দৃষ্টান্তও কম নয়। এই স্বশিক্ষিতদের আবার দেখা যায় শিল্প-সাহিত্য, নাটক-সিনেমা-মঞ্চ ও সাংবাদিকতাতেই বেশি। বিশেষ করে এক সময়ের চলচ্চিত্রে দেখা গেছে, যারা নায়ক-নায়িকা বা অভিনেতা-অভিনেত্রী হয়ে এসেছেন তাদের বেশির ভাগই ছিলেন স্বল্প শিক্ষিত। তখন উচ্চশিক্ষিতরা সহজে সিনেমা পাড়ায় পা ফেলতে চাইতেন না সামাজিকভাবে তিরস্কৃৃত হওয়ার ভয়ে। এ ব্যাপারে উপমহাদেশের সোনালি যুগের সুপার স্টার ধীরাজ ভট্টাচার্য বলেন, 'আমি যখন প্রথম সিনেমায় শুটিং করছি এটা পরিবার জানতে পারে তখন আমার মা আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন, নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে বাবা গুরুগম্ভীর হয়ে থাকেন।' পরে তাকে সিনেমা ছেড়ে পুলিশের চাকরি নিতে হয়। পরবর্তীতে সেই ধীরাজ ভট্টাচার্যকে সুপারস্টার হিসেবে দর্শক ভুলে গেলেও মানুষ আজও মনে রেখেছে তাকে তার মাথিনের কূপ কেন্দ্রিক 'যখন পুলিশ ছিলাম' নামক কালজয়ী উপন্যাসটির কারণে।

চলচ্চিত্রে শিক্ষিতদের জন্য সেই দুঃসময়টা বহু আগেই অতীত হয়ে গেছে। ঢাকাই চলচ্চিত্রে উচ্চশিক্ষিত তারকাদের সংখ্যা হাতেগোনা হলেও এখন উচ্চশিক্ষিদের আগমন বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বলা চলে, হালে ঢাকাই সিনেমায় উচ্চশিক্ষিতদের আগমন বাড়ছে। যদিও এই উচ্চশিক্ষিতদের আগমনের ধারা হঠাৎই ঘটেনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে বা তার কিছু আগে পরে থেকেই মূলত একটু একটু করে এই উচ্চশিক্ষিতদের আগমন ঘটে। এক্ষেত্রে চিত্র নায়ক ওয়াসিম, উজ্জ্বল, আলমগীর, সোহেল রানা, ইলিয়াস কাঞ্চন, মাহমুদ কলি, হুমায়ুন ফরিদী, মিশা সওদাগর, ফেরদৌস আহমেদ, রিয়াজ, অপি করিম, বিপাশা হায়াত, সুমাইয়া শিমু প্রমুখের নাম করা যায়। তাদের মধ্যে অনেকে একই সঙ্গে নাটক ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন।

সিনেমা দেখতে মানুষের অভাব না হলেও সিনেমায় আগমন নিয়ে পরিবার ও সামাজিকভাবে প্রায় সবাইকেই কোণঠাসা অবস্থায় থাকতে হয়েছে। বিশেষ করে অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে। তারপরেও এক সময় অত্যন্ত স্বল্প লেখাপড়া নিয়েও অভিনেত্রীরা অনেক সাহসের পরিচয় দিয়েছেন সিনেমার অভিনয়ে। আবার পরবর্তীতে যারা উচ্চ শিক্ষিত হয়েও একটি অনিশ্চিত জীবনের মতো চলচ্চিত্রে পা রেখেছেন তারাও কম সাহসের পরিচয় দেননি। বিশেষ করে অভিনেত্রীরা। মূলত চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেই এক সময়ে উচ্চশিক্ষিতদের চলচ্চিত্রে নাম লেখাতে দেখা যায়। আবার কেউ কিছুদিন অভিনয় শেষে একপর্যায়ে টিকতে না পেরে চলেও গেছেন। যেমন- বিপাশা হায়াত, মাহমুদ কলি প্রমুখ। স্বল্প শিক্ষিতরা যেমন অস্তিত্বের প্রয়োজনেই সহজে হাল ছাড়েন না, উচ্চশিক্ষিতরা সেখানে তার বিকল্প ব্যবস্থা থাকায় চলেও যান বা কেউ একই সঙ্গে দুটোই চালিয়ে যান।

একটা সময়ে সিনেমায় বা নাটকে উচ্চশিক্ষিত ছেলের সংখ্যা মোটামুটি থাকলেও নায়িকা বা অভিনেত্রী বলতে গেলে ছিলই না। তবে হালে গত দশ বছরে সে ধারা পাল্টেছে। এখন নতুন নায়িকা বা অভিনেত্রীরা উলেস্নখযোগ্য হারেই উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন না হয় গ্রহণ করেছেন। এমন অভিনেত্রীদের মধ্যে আছেন যেমন সুমাইয়া শিমু যিনি পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। ইয়ামিন হক ববি ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেছেন। অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করা শবনম বুবলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করছেন। শাকিবা বিনতে আলী এমবিএ সম্পন্ন করা গোল্ড মেডেলিস্ট। নায়িকা আঁচল স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেছেন। জাকিয়া বারী মম জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যকলা বিভাগে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন। জান্নাতুল পিয়া লন্ডন থেকে আইনে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করে এখন অভিনয়ের পাশাপাশি আইন পেশাতেও জড়িত।

অনেক অভিনেত্রী আছেন যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন কিন্তু নানা কারণে অসম্পন্ন অবস্থায় আছেন। তাদের মধ্যে আছেন মাহিয়া মাহী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। একই অবস্থা বিবিএ গ্রহণ করা নুসরাত ফারিয়ারও। বিদ্যা সিনহা মিমও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিদিন ক্লাস করতে পারেননি। পরে ভর্তি হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ লেভেল এবং ও লেভেল সম্পন্ন করা অর্চিতা স্পর্শিয়া পরে মিডিয়া স্টাডিজ ও জার্নালিজমে অনার্স করেছেন ইউল্যাব থেকে। এতে তার প্রধান বিষয় ছিল ডিজিটাল প্রোডাকশন (চলচ্চিত্র নির্মাণ)। পিয়া বিপাশা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। জ্যোতিকা জ্যোতি ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন থেকে ইংরেজিতে অনার্স সম্পন্ন করেছেন। আলিশা প্রধান ইংলিশ মিডিয়াম প্রতিষ্ঠান থেকে এ লেভেল সম্পন্ন করে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন ইডিক্সেল-এ।

উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা এবং অসম্পন্ন রাখা উভয় মিলিয়েই দেখা যাচ্ছে হালে ঢাকাই চলচ্চিত্রে আসা অধিকাংশ নায়িকা বা অভিনেত্রীই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে এক সময়ে যেখানে নায়কদের তুলনায় নায়িকারা পিছিয়ে ছিলেন হালে দেখা যাচ্ছে সেখানে নায়ক বা অভিনেতাদের তুলনায় নায়িকা বা অভিনেত্রীরাই এগিয়ে যাচ্ছেন। এটা ঢাকাই চলচ্চিত্রের জন্যও একটা সুবাতাস বয়ে আনবে এবং তা আনছেও। এতে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও যেমন গুণগত পরিবর্তন আসছে এবং আগামীতে আরও আসবে। সেইসঙ্গে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পেশা আরও বেশি সম্মানজনক হয়ে উঠতে সহায়ক হবে। অভিনয়ে যদি একজন নায়িকা উচ্চশিক্ষিত হন তখন অভিনয়ের ক্ষেত্রেও তার আত্মবিশ্বাসও অনেক বেড়ে যায়। বাচনভঙ্গিতে আসে সহজ-স্বাভাবিকতা। এ ধরনের অভিনয় শিল্পীরা তখন আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্রেও কাজ করতে পারেন খুব সাবলীলভাবে। বর্তমানে যে বাংলাদেশের সিনেমা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হচ্ছে তার বেশির ভাগ সিনেমার পারফর্মাররাই শিক্ষিত। ষাট-সত্তর দশকের সময়ে যেসব সিনেমার নির্মাণ হতো সেসব সিনেমায় সাধারণ শিক্ষিত হলেও কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু বর্তমানে ঢাকাই সিনেমা যেরকম আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে যাচ্ছে সেজন্য অভিনয় শিল্পীদের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারেও প্রভাব আছে।

তবে দুঃখের বিষয় যখন ঢাকাই সিনেমা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে যাচ্ছে তখনই প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বর্তমানে মাত্র ৪৬টি প্রেক্ষাগৃহ নিয়মিত খোলা থাকে। এখন ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির জন্য প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা বাড়ানোটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চলচ্চিত্রে উচ্চশিক্ষিত অভিনয় শিল্পীর দিক থেকে আগের তুলনায় যেরকম অনেক গুণগত পরিবর্তন আসছে সেটা অব্যাহত রাখার জন্য তেমনি দর্শককেও প্রেক্ষাগৃহমুখী করানো জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি প্রেক্ষাগৃহ বাড়িয়ে চলচ্চিত্রের এই গুণগত পরিবর্তনটিও অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে