শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন খল-নায়ক জুটির অভাবে ঢাকাই সিনেমা

মাসুম বিলস্নাহ্‌ (রাকিব)
  ০৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
খল-নায়ক মিশা সওদাগর ও নায়ক শাকিব খান অভিনীত একটি সিনেমার অ্যাকশনের মুহূর্ত

সিনেমায় বরাবরই খলনায়কদের ভূমিকা অপরিসীম। তারাই গল্পকে শ্বাসরুদ্ধকরভাবে এগিয়ে নিয়ে গতি এনে দেন। দর্শকপ্রিয়তা তৈরিতে খলনায়করাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এককালে খলনায়কদের দেখার জন্যই হলে গেছে মানুষ। পর্দায় তাদের মৃতু্যতে উলস্নাস করে হাততালি দিয়েছে।

চলচ্চিত্রের ভিলেন বা খলনায়কের প্রধান কাজই হলো নায়ক-নায়িকা কিংবা তাদের পরিবার ও পরিচিতজনদের ক্ষতি করা। খল চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল খারাপ কিংবা অহিতকর কর্মকান্ড করা। এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র আবদুল জব্বার খান পরিচালিত 'মুখ ও মুখোশ' ছবিতে প্রধান চরিত্রই ছিল ডাকাত চরিত্রের খল। 'মুখ ও মুখোশ' ছবিতে প্রধান খল চরিত্র সমসের ডাকাতের রূপায়ণ করেছিলেন ইনাম আহমেদ। এরই ধারাবাহিকতায় বিএফডিসি থেকে নির্মিত প্রায় সব চলচ্চিত্রেই খলচরিত্রের উপস্থিতি যেন অনিবার্যভাবেই ঘটে চলেছে। খলরূপে রূপায়িত চরিত্ররা কোনো কোনো সময় চলচ্চিত্রের প্রথমার্ধে ভালো মানুষের চেহারা লালন করে। অতঃপর সময়-সুযোগ অনুযায়ী নিজেদের খলতার রূপ উন্মোচন করে। এমন গল্প নিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রে সিনেমা কম হয়নি।

একটা সময় বাংলা চলচ্চিত্রে গোলাম মুস্তাফা, রাজীব, খলিল, আহমেদ শরীফ, এ টি এম শামসুজ্জামান, হুমায়ূন ফরিদী, সাদেক বাচ্চুদের সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন একেকজন বড় বড় ডাকসাইটে তারকা খল।

অপরদিকে নারী খল চরিত্রের মধ্যে রওশন জামিল, মায়া হাজারিকা, রিনা খান, জাহানারা ভূঁইয়া, শবনম পারভীন, নাগমা, দুলারিরা সমাদৃত হয়েছেন। অভিনয় দিয়ে তারা সমৃদ্ধ করে গেছেন অভিনয়ের আঙিনাকে। তারা কিন্তু নায়ক হয়ে নয়, নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করে কখনো ছাড়িয়ে গেছেন একটি সিনেমার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করা নায়ককেও। সেই মাপের খল অভিনেতার দাপট এখন ঢাকাই সিনেমায় আগের মতো বলতে গেলে নেই-ই।

বর্তমানে খল চরিত্রের ক্ষেত্রে সে মানের অভিনেতার যেরকম সংকট দেখা যাচ্ছে তাতে হয় অদূর ভবিষ্যতে উলেস্নখযোগ্য কোনো খল অভিনেতা দেখা যাবে কিনা সেটা নিয়ে এখনই অনেকে সংশয় প্রকাশ করছেন। শিবা শানু, শিমুল খান, ডিজে সোহেল, জাহিদ, টাইগার রবি, জিয়া ভিমরুল খল চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হলেও নিজের আসন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের অভিনয় নিয়ে যতটা না হতাশা, তার চেয়ে চরিত্র নিয়েই হতাশা বেশি। তাদের এখন নামকা ওয়াস্তে রাখা হয়। যেখানে খল চরিত্র হিসেবে তাদের খুব বেশি প্রমাণের সুযোগও নেই।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন অভিনেতাকে খলচরিত্রে সুনামের সঙ্গে অভিনয় করতে দেখা গেছে। তাদের বেশির ভাগই ছোট পর্দা থেকে আসা অভিনেতা। শহিদুজ্জামন সেলিম, রাশেদ মাহমুদ অপু, মিলন, তাসকিন, সীমান্ত, ইরেশ যাকেরসহ আরও কয়েকজন খল চরিত্রে বেশ নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। খল চরিত্রে অভিনয় করেও যে স্টার হওয়া যায়। তার সর্বশেষ প্রমাণ তাসকিন রহমান। 'ঢাকা অ্যটাক' সিনেমায় তার চরিত্রের গুরুত্ব ছিল। এটা দেখার পর সংশ্লিষ্টদের অনেকে মনে করেছিলেন ভিলেন চরিত্রে ঢাকাই সিনেমায় পরবর্তী কান্ডারি হয়তো তাসকিন আহমেদ হবেন। কিন্তু বছরে তার যে হারে সিনেমা মুক্তি পায় এত অল্প সংখ্যক সিনেমায় অভিনয় করে কীভাবে তিনি সেই কান্ডারি হতে পারবেন? একসময় যেখানে হুমায়ুন ফরীদি, রাজিব, সাদেক বাচ্চু প্রমুখদের বছরে যেরকম দু'চারটি সিনেমা থাকত তাসকিন সেরকম সুযোগই পাচ্ছেন না।

চলচ্চিত্রের জুটি খুব শুরুত্বর্পূণ বিষয়। নায়ক-নায়িকা জুটির মতোই সিনেমার দর্শক উপভোগ করেছেন নায়ক-ভিলেন জুটিগুলোও। একসময় গোলাম মোস্তফা, খলিল উলস্নাহ খান, এ টি এম শামসুজ্জামানরাই ভিলেন হিসেবে চলচ্চিত্র মাতিয়েছেন। সেই সময় তাদের সঙ্গে নায়ক হিসেবে দেখা যেত রাজ্জাক, ফারুক, ওয়াসিম, আলমগীর, সোহেল রানা, উজ্জ্বলদের। তবে এই ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক নায়কের ছবিতেই বিশেষ ক'জন ভিলেনকে দেখা যেত নিয়মিতই। এই সফল জুটিদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য কয়েকটি জসিম-আহমেদ শরীফ: পর্দায় নায়ক জসিমের সঙ্গে ভিলেন হিসেবে জুটি গড়ে ওঠেছিল আহমেদ শরীফের। সুভাষ দত্তের 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী' ছবিতে নায়ক হিসেবে অভিষিক্ত হলেও এই অভিনেতা ভিলেন হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বহু ছবিতে জসিম-আহমেদ শরীফের ভালো-মন্দের কেমিস্ট্রি দর্শক মাতিয়েছে। কিন্তু ভিলেনদের সেরকম জুটি গড়ে উঠছে না।

যেমন দেখা গেছে শাকিব-মিশা জুটির ক্ষেত্রে। ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশিবার একজন ভিলেনের সঙ্গে অভিনয় করেছেন নায়ক শাকিব খান। প্রায় ১০ বছরের বেশি ধরেই ঢাকাই সিনেমার একক আধিপত্য নিয়ে সিনেমা করে চলেছেন তিনি। আর তার প্রায় ৯০ ভাগ সিনেমাতেই ভিলেন হিসেবে কাজ করেছেন মিশা সওদাগর। তাদের সব সিনেমাই ব্যবসায়িক সাফল্য না পেলেও জুটি হিসেবে নির্মাতাদের সেরা পছন্দ এখন পর্যন্ত মিশা-শাকিবই। এই জুটির পর এখন পর্যন্ত আর কোনো নায়ক-ভিলেন জুটি গড়ে উঠতে পারেনি।

এক সময় নায়ক হিসেবে জনপ্রিয় হলেও পরবর্তী সময়ে যারা নিজেদের খল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তাদের উলেস্নখযোগ্য ওমর সানী, রুবেল, আলেকজান্ডার বো, অমিত হাসান। কিন্তু তারা কেউই এ ক্ষেত্রে দর্শক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। এদের মধ্যে অমিত হাসান অবশ্য তার একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু দেশের নির্মাতারা তাকেও তেমন কাজে লাগাতে পারেননি।

এ অবস্থায় মিশা-শাকিব জুটির অবর্তমানে ভিলেন চরিত্রে পরবর্তী কান্ডারি কারা হচ্ছেন এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছে ঢাকাই সিনেমা। এখন তো সবাই নায়ক-নায়িকা হতে চায়। কেউ ভিলেন হতে চায় না। চেহারা নায়কের মতো না হলেও নায়ক হতে চায়।

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, 'নতুন প্রজন্মের দোষ দিয়ে লাভ নেই। পরিচালক-প্রযোজকরাই তাদের ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছেন না। আবার নতুনদেরও সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। যাকে যেমন মানিয়ে যায় তেমন চরিত্রেই অভিনয় করা উচিত। নায়ক হতে পারলে নায়িকার সাহচর্য পাওয়া যায় এমন লোভ পরিহার করা উচিত। সবচেয়ে বড় কথা, অভিনয়কে পেশা হিসেবেই নেওয়া উচিত। নেশা হিসেবে নয়। তাহলেই তার অভিনয়ে পেশাদারিত্ব আসবে। এমনকি নায়কদেরও কখনো কখনো একটা এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে খল চরিত্রেও অভিনয় করে নিজেকে প্রমাণ দেওয়া উচিত।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে