শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কনকনে শীতে স্থবির উত্তরের জনজীবন

যাযাদি ডেস্ক
  ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
তীব্র শীত জেঁকে বসেছে গাইবান্ধায়। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। ছবিটি রোববার তোলা -ফোকাস বাংলা

মাঘের শুরুতে দেশের উত্তরাঞ্চলে হাড়কাঁপানো শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। দিনে সূর্যের দেখা মিললেও রোদে নেই উষ্ণতা। সন্ধ্যার পর তাপমাত্রা কমতে শুরু করায় এবং ঘন কুয়াশায় জনপদ হয়ে পড়ছে জনশূন্য। কনকনে শীতে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। উত্তরের বিভিন্ন জেলায় বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। সেটা আরও এক বা দুইদিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে রোববার জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আমাদের ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, গত দুইদিন থেকে আবারও শুরু হয়েছে শৈত্যপ্রবাহ। দিনের অর্ধেক সময় ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকছে জনপদ। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় জড়ো-সড়ো হয়ে পড়েছে মানুষ। প্রয়োজন ছাড়া অধিকাংশ মানুষ বাড়ির বাহির হচ্ছেন না।

এদিকে, ঘন কুয়াশার কারণে বোরো বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার কথা বলছেন বোরোচাষিরা। তারা বলেছেন, তীব্র শীতের কারণে বোরো বীজ চারার ক্ষতি হচ্ছে। তবে কৃষকের সেই অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুম্মান আক্তার বলেছেন, বর্তমানে বোরো বীজ চারা অনেক বড় হয়েছে, তাই ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।

এদিকে, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। শীতে গরম কাপড়ের দাম বেশি হওয়ায় গরম কাপড় কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। দিনমজুর আজগর আলীসহ কয়েকজন বলেন, এখন বাজারে মোটা চাল ৪৫-৫০ টাকা, একই সঙ্গে পালস্না দিয়ে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য, সংসার চালানো এবং গরম কাপড় কেনা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে, শীতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার মশিউর রহমান বলেন, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর ভিড় বাড়ছে। তাদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশি।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রিয়াজ উদ্দিন বলেন, সরকারের বরাদ্দকৃত কম্বল দেওয়া শুরু হয়েছে, তিনি শীতে গরিব মানুষকে বাঁচাতে সরকারের

পাশাপাশি সমাজের বৃত্তবানদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

ডোমার (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, দেশের সর্ব উত্তরের জেলা নীলফামারীর ডোমারে বইছে শৈত্যপ্রবাহ। সেই সঙ্গে হিমেল হাওয়া। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই উপজেলায় প্রচন্ড ঠান্ডায় জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। ঘন কুয়াশা আর মেঘে আকাশ ঢেকে রয়েছে। গতকাল উত্তাপহীন সূর্য কিছুক্ষণের জন্য উঁকি মেরে আবারও মিলিয়ে যায়। রাতের বেলা বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরছে। মাঠ-ঘাটে লোকজনের উপস্থিতি কমে গেছে। বিকালের পর থেকে রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ছে। প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না। ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। রাস্তাঘাটে মানুষজন আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। গত দুইদিন ধরে ঘন কুয়াশায় ঢাকা ছিল পথঘাট।

উপজেলা প্রশাসন থেকে ১০ ইউনিয়নে ছয় হাজার ৬০০ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পৌরসভা ও ব্যক্তি উদ্যোগে কম্বল বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রচন্ড ঠান্ডায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে শিশু ও বৃদ্ধরা। ইতোমধ্যে শীতজনিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও প. প. কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহীম জানান, ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্টের রোগী বেশি। তবে শীত যে হারে বেড়েছে, রোগীর সংখ্যা তেমন বাড়েনি।

সৈয়দপুর (নীলফামারী) সংবাদদাতা জানান, মাঘের হঠাৎ করে কদিন থেকে হিমেল হাওয়া, কনকনে শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে পুরো নীলফামারী জেলার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র শীতে মানুষজন ঘরের বাহির হতে পারছে না। দুপুর পার হয়ে গেলেও সূর্য়ের দেখাও মিলছে না। সৈয়দপুরের মানুষজন শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে বাড়ির বাহিরে প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছেন না। খেটে খাওয়া মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। কর্মজীবীরা সকালে তাদের কর্মস্থলে যেতে শীতে কাবু হয়ে পড়ছেন।

বিভিন্ন এলাকায় শীত তাড়াতে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কনকনে ঠান্ডায় মানুষজন কাজকর্ম না করতে পেরে পরিবার-পরিজন নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। অপরদিকে ঠান্ডার প্রকোপে বয়স্ক ও শিশুদের শীতজনিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে।

ইতোমধ্যে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন শীতবস্ত্র বিতরণ করলেও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ ছাড়া এমনও অভিযোগ রয়েছে, এমন সব শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়, যেগুলো নামমাত্র শীতবস্ত্র, সেগুলো দিয়ে শীত নিবারণ হয় না। এদিকে শীতের তীব্রতায় এখন নতুন করে আবারও মানুষজন প্রতিদিন শীতবস্ত্রের দোকানগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন।

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশায় কাবু হয়ে পড়েছে চিলমারীর জনজীবন। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের হাজারও শীতার্ত মানুষের নিদারুণ কষ্ট বেড়েছে। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র না থাকায় খড়কুটোর আগুনই ভরসা শীতার্ত দুস্থ মানুষের। শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে দিনে ও রাতে খড়কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা নিচ্ছেন তারা। ঠান্ডার কারণে কাজের সন্ধানে ঘরের বাইরে যেতে হিমশিম খাচ্ছেন খেটে-খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট আবহাওয়া অফিসের তাপমাত্রা রেকর্ড কিপার সুবল চন্দ্র রায় জানান, রোববার সকাল ৮টায় সর্বনিম্ন ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। সকালে ঘন কুয়াশায় চারদিক ঢেকে ছিল।

উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের চর নয়ারহাট এলাকার দিনমজুর গোলেনুর বেগম (৪৮) জানান, ঠান্ডায় তিনি কাবু হয়ে পড়েছেন। ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারছেন না কাজের জন্য। চর অষ্টমীর বড় চরের শামছুন্নাহার (৩৯) জানান, ঠান্ডার কারণে ক্ষেতে বেশিক্ষণ কাজ করতে পারছেন না। আধ ঘণ্টা কাজ করলেই শরীর ঠান্ডায় বরফ হয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন থেকে ঠান্ডার প্রকোপ আরও বেড়েছে।

চিলমারী স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের টিএইচও আমিনুল ইসলাম বলেন, 'শীতের তীব্রতা বাড়ায় শিশু ও বয়স্কদের শীতজনিত রোগের ঝুঁকি বেড়েছে'।

ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি জানান, উত্তর থেকে ধেয়ে আসা কনকনে শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাবনার ঈশ্বরদীর জনজীবন। গত তিনদিন থেকে দুপুর গড়িয়ে গেলেও সূর্যের মুখ দেখা যায় না। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারে কিছু দোকান খোলা হলেও বেশির ভাগ দোকান বন্ধ থাকে। চাকরিজীবীরা প্রয়োজনের তাগিদে বের হলেও অধিকাংশ মানুষ বাসাতেই সময় কাটাচ্ছেন। কিছু কিছু রিকশা সড়কে দেখা গেলেও অধিকাংশ চালক শীত সহ্য করতে না পেরে বাড়িতেই অবস্থান করছেন। কিছু মানুষের ভিড় দেখা যাচ্ছে পুরনো গরম কাপড়ের মার্কেটে। কেউ কেউ বাড়ির সামনে খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। প্রচন্ড শীতে শিশুদের ঠান্ডাজনিত রোগ দেখা দিয়েছে। হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা আগের চেয়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস এবং ট্রেনেও শীতে যাত্রী সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। বাসটার্মিনাল এবং রেলস্টেশনে ভাসমান মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন অতিবাহিত করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে