শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখী উৎসব ঘিরে বাণিজ্যে 'ধস'

ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে এমনিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এর ওপর একই মাসে দুই উৎসবের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদসহ আনুষঙ্গিক কেনাকাটা একেবারেই অসম্ভব। যারা বৈশাখী উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা সামগ্রী তৈরি করে মজুত করেছেন তারা মহাবিপাকে পড়েছেন
সাখাওয়াত হোসেন
  ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
ঈদে প্রিয়জনদের জন্য পোশাক কিনতে ফুটপাতের দোকানগুলোয় সাধারণ মানুষের ভিড় বাড়ছে। ছবিটি শনিবার রাজধানীর গুলিস্তান এলাকা থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

রাজধানীর ডিওএইচএস বারিধারার বায়িং হাউস আরএম গ্রম্নপের সহকারী হিসাব রক্ষক মৌসুমী ইসলাম আগে প্রতি বৈশাখে নিজের জন্য নতুন পোশাক কিনতেন। সঙ্গে ছোট ভাইবোনদের জন্যও কিছু কেনাকাটা করতেন। তবে এবার কারও জন্য তিনি কিছুই কেনেননি। কারণ পহেলা বৈশাখের মাত্র এক সপ্তাহ পরই ঈদ। ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে এমনিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এর ওপর একই মাসে দুই উৎসবের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদসহ আনুষঙ্গিক কেনাকাটা একেবারেই অসম্ভব। তাই সাধ থাকলেও সাধ্যির সঙ্গে সমন্বয় রাখতে গিয়ে অনেক শখের সঙ্গে এবার বৈশাখী উৎসব উদযাপনের আনন্দ কাটছাঁট করতে হচ্ছে।

একই অবস্থা সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষিকা তাহমিদা আফরোজের। কারও জন্যই এবার বৈশাখী পোশাক কেনেননি। অথচ নিজের জন্য না পারলেও ছেলেমেয়েদের জন্য পোশাক কেনা হয়নি অতীতের এমন রেকর্ড নেই।

শুধু মৌসুমী ইসলাম কিংবা তাহমিদা আফরোজই নন, তাদের মতো অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারই এবার বৈশাখী কেনাকাটার পুরো বাজেটেই কাঁচি চালিয়েছেন। নিম্নবিত্তের চোখ থেকেও বৈশাখী উৎসবের স্বপ্ন অনেক আগেই উধাও। তবে আর্থিক টানাটানিতে স্ত্রী-সন্তান ও বাবা-মা, ভাইবোনসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের ঈদ আনন্দ যাতে পুরোপুরি মাটি হয়ে না যায় সে জন্য বেশিরভাগ মানুষ ঈদ কেনাকাটার জন্য কিছু অর্থ হলেও আলাদা করে রাখার চেষ্টা করছেন। কেউবা এরইমধ্যে সাধ্য অনুযায়ী ঈদের পোশাক-পরিচ্ছদসহ আনুষাঙ্গিক সামগ্রী কিনছেন। খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষ বৈশাখী উৎসবের জন্য কেনাকাটা করছেন। তাই এ বছর বৈশাখী বাণিজ্যে কতটা ধস নামবে এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা চরম দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে যারা বৈশাখী উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা সামগ্রী তৈরি করে মজুত করেছেন তারা মহাবিপাকে পড়েছেন।

করোনাভাইরাসের মহামারি বাঙালির উৎসবের ক্যালান্ডারে চারটি ঈদ আর দুটি বৈশাখের রং মুছে দিয়েছিল প্রায়। পোশাক ব্যবসায়ীদের জন্য ২০২০ আর ২০২১ ছিল মন্দার বছর। বেকারত্ব বৃদ্ধি ও আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় ২০২২ সালের দু'টো ঈদের কেনাকাটা কিছুটা জমলেও বৈশাখী বাণিজ্য তেমন জমেনি। সাধ আর সাধ্যের হিসাব কষতে গিয়ে বেশিরভাগ মুসলিম পরিবার বৈশাখী উৎসবকে পাশ কাটিয়ে ঈদ আনন্দ ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন।

সরেজমিনে রাজধানীর নামিদামি শপিংমল ও বিপণি-বিতানের পাশাপাশি নিম্ন-মধ্যবিত্তের বিভিন্ন মার্কেট এবং ফুটপাতের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বৈশাখী পণ্যের কেনাকাটা নেই বললেই চলে। যেসব দোকানে শুধু এ উৎসবকেন্দ্রিক পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, সেখানে অনেকটাই ক্রেতাশূন্য। তরুণ-তরুণীসহ উৎসুক কিছু মানুষ বিভিন্ন জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করে দর কষাকষি করলেও কেনাকাটা করছে খুবই কম। এসব দোকানিরা অনেকে দোকানের নিত্যদিনের খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন।

বিক্রেতারাও এ বিষয় নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, দুটো উৎসব কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় এবার বিক্রি কমেছে অনেকটা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে আর্থিক সংকটে থাকা ক্রেতারা বৈশাখী পণ্য কিনতে আসছেন কম। কেনাকাটার জন্য অনেকেই দুটো উৎসবের মধ্যে ঈদকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের রোজার ঈদে আনুমানিক ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। সেবার পহেলা বৈশাখ ঘিরে বিক্রি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকার মতো পোশাক। এবার তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সামগ্রিকভাবে মানুষের উৎসবকেন্দ্রিক খরচ করার প্রবণতা অনেকটা কমেছে। মানুষ এখন নানা যোগ-বিয়োগ করে কেনাকাটা করে। তাদের মধ্যে আশঙ্কা, দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি কতটা অস্থিতিশীল হবে, আগামী দিনে আয়-ব্যয়ের ফারাক কতটা বাড়বে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, 'আগে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক, জুতা ও অন্যান্য সাজসজ্জার প্রসাধনী বিক্রি হতো ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার। এবার সেটা কমে ৪০০-৫০০ কোটি টাকায় নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।'

এর কারণ হিসেবে দোকান মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, 'একে তো রোজা। তার ওপর অসহনীয় যানজট। মানুষের আয়-রোজগারও কমেছে। জিনিসপত্রের দামও হু হু করে বাড়ছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ কারণে বৈশাখের বাজার তেমন জমেনি।' তার আশঙ্কা, ঈদের বাজারও এ বছর খুব জমবে না। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বৈশাখ আর ঈদ পড়ে যাওয়ায় অনেকে শুধু ঈদের পোশাক কিনবে।

ফারহানা ফ্যাশনের সিইও জান্নাত আরা মৌ বলেন, 'ঈদের পাশাপাশি আমরা বৈশাখেরও কালেকশন শপে তুলেছি। ক্রেতাও আছে, তবে কম। সনাতন ধর্মাবলম্বী মুষ্টিমেয় ক্রেতা বৈশাখের পোশাক কিনছেন। মুসলমানদের অনেকে এমন পোশাক কিনছেন, যা দিয়ে বৈশাখ ও ঈদ দুটো উৎসবই উদযাপন করা যায়।'

একই অবস্থা আড়ংয়ের মতো প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ডেরও। এবার বৈশাখের কালেকশনে আলাদা কোনো নজর দিতে পারেনি তারা। বৈশাখের বেচাকেনাও তেমন হচ্ছে না বলে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

মৌচাক মার্কেটে দোকানি পিয়াল রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। গত এক সপ্তাহে মার্কেটের অবস্থা ভালো না। মানুষের হাতে টাকা নেই। জিনিসপত্রের দামও বেশি। মানুষ খাবে নাকি উৎসবের পোশাক কিনবে?

ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদে নতুন জামা-জুতা, প্রসাধনী কেনার রেওয়াজ বরাবরই ছিল। তবে বৈশাখ ঘিরে নতুন পোশাক কেনার চল মোটামুটি দুই দশকের। প্রথম দিকে তা শুধু উচ্চবিত্তের মধ্যে থাকলেও ফ্যাশন হাউসগুলোর চেষ্টায় নিম্ন-মধ্যবিত্তের কাতারেও তা পৌঁছে গিয়েছিল। তবে এখন সর্ব শ্রেণির কেনাকাটাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আগে পহেলা বৈশাখে সারা বছরের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পোশাক বিক্রি হতো। আর ঈদে বিক্রি হতো ৪০ শতাংশ। এখন কোনো টার্গেটই পূরণ হচ্ছে না।

এদিকে রাজধানীর অন্যান্য মার্কেটের তুলনায় বসুন্ধরা শপিং কমপেস্নক্সের দেশীয় পোশাকের ফ্যাশন হাউস ও শাহবাগ মার্কেটের দোকানগুলোতে বৈশাখী পোশাক কেনার ক্রেতার আনাগোনা বেশি দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বছর রোজার কারণে এবং ঈদ ও বৈশাখী উৎসব কাছাকাছি সময়ে হওয়ার কারণে ফ্যাশন হাউসগুলোও পহেলা বৈশাখের জন্য সীমিত পোশাক তৈরি করেছে। মালিকরা বলছেন, বৈশাখের বাজার ধরার যখন প্রস্তুতি নেওয়ার সময়, তার আগে থেকেই দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী। বেশিরভাগ পরিবারেই 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' অবস্থা। তাই তারা বৈশাখের উৎসবকেন্দ্রিক পণ্যের দিকে বেশি ঝুঁকি নেননি।

তাছাড়া রোজার কারণে বৈশাখের উৎসব এবার সীমিত হয়ে যাবে, সে চিন্তা থেকেও অনেক পোশাক প্রস্তুতকারক বৈশাখের আলাদা আয়োজন রাখেননি। যারা বৈশাখের পাঞ্জাবি, ফতুয়া, টি-শার্ট, কুর্তি, সালোয়ার কামিজ, শাড়ি, কাপ্তান পোশাক তৈরি করেছেন, তারা মাথায় রেখেছেন ঈদের বাজারেও যেন তা চালানো যায়।

অন্যান্য ফ্যাশন ডিজাইনের স্বত্বাধিকারী শবনম রহমান বলেন, রোজার ঈদের বলয়ের মধ্যে থাকায় এবার বৈশাখের আয়োজনটা তুলনামূলক কম। অনেকের ভাবনায় থাকবে, একই পোশাক বৈশাখ ও ঈদের জন্য কিনে ফেলব। আবার বৈশাখে শুধু এক দিনের জন্য একটা পোশাক কিনবে কিনা সেটা নিয়েও ভাবছে অনেকে। সেজন্য আমরা টোটাল প্রোডাক্ট লাইন এমনভাবে সাজিয়েছি যেন তা বৈশাখ ও ঈদ দুটোকেই কাভার করতে পারে।

প্রতি বছর বৈশাখের দুই-তিন সপ্তাহ আগেই ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে নববর্ষের পোশাক বিক্রির ধুম পড়ে যেত, এবার সেখানে ক্রেতার উপস্থিতি খুবই কম। এখানকার ফ্যাশন হাউসগুলোতে বৈশাখের পোশাকের সমাহারও অন্য বছরের চেয়ে কম।

এ মার্কেটে কে-ক্র্যাফটের শোরুমে বৈশাখের নতুন ডিজাইনের পাঞ্জাবি, শাড়ি ও সালোয়ার কামিজ দেখা গেল। দোকানের সেলসম্যানরা জানান, রোজার মধ্যে নববর্ষ পড়ায় বৈশাখের পণ্য অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন তারা। এরও কতটা বিক্রি হবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা রয়েছে।

তবে এ মার্কেটের বেশকিছু দোকানির আশা, খুব বেশি বিক্রি না হলেও বৈশাখী পোশাক বিক্রিতে ততটা ধস নামবে না। এ উৎসবের এখনও ১২/১৩ দিন বাকি। এ ছাড়া মানুষের হাতে এখনও চলতি মাসের বেতনের টাকা আসেনি। কয়েকদিন পর সরকারি চাকুরেদের হাতে উৎসব ভাতা ও বেতনের টাকা এলে ঈদ কেনাকাটার পাশাপাশি বৈশাখী বাণিজ্যও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। তারা সেই সুসময়ের প্রতীক্ষায় রয়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে