১৯৭১ সালে মার্চে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভে ফেটে পড়েন পূর্ব বাংলার আপামর জনগণ। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর পুরোপুরি পাল্টে যায় পূর্ব বাংলার আন্দোলনের চিত্র। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। পূর্ব বাংলায় চলতে থাকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। দিন যত গড়াতে থাকে আন্দোলনের তীব্রতাও তত বাড়তে থাকে।
১৯৭১ সালের এই দিনে চলমান সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে পুরোপুরি উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলা। ২৬ মার্চ যত ঘনিয়ে আসছিল আন্দোলনের মাত্রা তত বেগবান হচ্ছিল। এদিন
ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মিছিল সমাবেশ করে। মিছিল মিছিলে আর সেস্নাগানে সেস্নাগানে পুরোপুরি মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা পূর্ব বাংলা। মুক্তিকামী বাঙালির উত্তাল আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে চলতে থাকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি।
এমন খবর পাওয়ার পর রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকার। বিরোধীদলীয় নেতারা পাকিস্তানের অনিবার্য ভাঙন নিশ্চিত বুঝতে পারেন। তারা এদিন জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তারা অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। এমন প্রস্তাব নাকচ করে দেয় পাকিস্তানের জান্তা সরকার। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক কোনো প্রস্তাবের তোয়াক্কা না করে রীতিমতো হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। যাতে করে মুক্তিকামী জনতা ভয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়। আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের একাত্মতা ঘোষণা করছিল বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন। অসহযোগ আন্দোলন শুরুর এক সপ্তাহ পর থেকেই দেশ এক প্রকার অচল হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষক সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজেদের অস্তিত্বা রক্ষার জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা পূর্ব বাংলার এমন পরিস্থিতি দেখে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি আর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দেখে পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় নেতারাও শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এদিকে চলমান তীব্র আন্দোলনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার, ২৫ মার্চের আগে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানানো হয়।
এ সময় দেশের প্রতিটি গ্রামে গঞ্জে, হাট বাজারে, শহর, বন্দর, নগরে চলতে থাকে তীব্র অসহযোগী আন্দোলন। স্বাধীনতার অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে আন্দোলনে দিনকে দিন কঠোর কর্মসূচিতে রূপ নিতে থাকে। একাত্তরের উত্তাল সেই সময়ে পূর্ব বাংলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন অসহযোগ আন্দোলনে। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা আন্দোলন পরিচালনার জন্য নিজেদের একদিনের বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাজপথে মিছিল করে। সেই আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা এনে দেয়।