শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় অস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপনের ঘটনায় তোলপাড়

বিক্রীত অস্ত্র উদ্ধার ও ক্রেতাদের গ্রেপ্তারে অভিযান হ মূর্তি তৈরি থেকে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারিগর
গাফফার খান চৌধুরী
  ২০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

খোদ ঢাকায় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানা আবিষ্কৃৃত হওয়ার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কারণ বিভিন্ন সময় ঢাকা থেকে মারাত্মক এবং ভারি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হলেও, আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়নি। সদ্য আবিষ্কৃত কারখানা থেকে বেশ কিছু পিস্তল বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রীত আগ্নেয়াস্ত্র ও সেগুলোর ক্রেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।

র্

যাব জানায়, গত ১১ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্তর্ যাব-১০ ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। এ সময় ঢাকার উত্তর বাড্ডার একটি তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান মিলে। কারখানা থেকে জব্দ হয় বিক্রির উদ্দেশ্যে পুরোপুরি প্রস্তুত করা পিস্তল ও পিস্তল তৈরির সব সরঞ্জাম। গ্রেপ্তার হয় অস্ত্র তৈরির মূল কারিগর ও তার প্রধান সহযোগীসহ ছয়জন। গ্রেপ্তারদের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলের্ যাব-১০ এর অধিনায়ক পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় পুরোটা জুড়েই অস্ত্র তৈরির কারখানা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। দু'টি বড় বড় রুম রয়েছে ফ্ল্যাটটিতে। একটি রুমে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল। অপর রুমে শুধু সামান্য একটু ঘুমানোর জায়গা ছিল। আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির মূল কারিগর ও তার সহযোগীরা সেখানে বসেই আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করতেন। জব্দ হওয়া পিস্তলগুলো খুবই আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয়। আগ্নেয়াস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত ক্ষুদ্র সরঞ্জামগুলো ভারত থেকে আনা হতো। পৃথক পৃথকভাবে সরঞ্জাম আনার পর ঢাকার কারখানাটিতে পুরোপুরি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হতো পিস্তল।

তিনি আরও বলেন, কারখানায় তৈরি করা বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করে দিয়েছে চক্রের মূলহোতা সাগর ও তার সহযোগী

তানভীরসহ চারজন। যদিও গ্রেপ্তাররা মাত্র কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির দাবি করেছেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, বিক্রীত আগ্নেয়াস্ত্রের পরিমাণ অনেক। কারণ গত এক বছর ধরে চক্রটি ওই বাড়িতেই বসে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে বিক্রি করেছে। আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর ক্রেতাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বিক্রি হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ও ক্রেতাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

র্

যাব সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তাররা একটি অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী চক্র। চক্রের মূলহোতা ও অস্ত্র তৈরিকারক মোখলেছুর রহমান সাগর। তিনি পেশায় মূর্তি তৈরির কারিগর। ভারতে পূজা-অর্চনা অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় দেব-দেবীর মূর্তির চাহিদা স্বাভাবিক কারণেই বেশি। এজন্য সাগর বাংলাদেশ ছেড়ে পাড়ি জমান ভারতের কলকাতায়। সেখানে কিছু দিন কাজ করার পর আরও বেশি টাকার আশায় চলে যান আসামের শিলিগুড়িতে। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় সুকুমার নামের এক ভারতীয় অস্ত্র তৈরির কারিগরের সঙ্গে। সাগর টানা একযুগ কাজ করেছেন ভারতে। অস্ত্র তৈরিতে পারদর্শী হওয়ার পর ফিরেন নিজ দেশে। মূর্তির তৈরি কারিগর সাগর হয়ে যান অস্ত্র তৈরির কারিগর।

র্

যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাগরের তৈরি করা আগ্নেয়াস্ত্র দেখতে খুবই আকর্ষণীয় ও অত্যাধুনিক। বিশেষ করে পিস্তলগুলো ছিল নজর কাড়ার মতো। ফলে দেশীয় বাজারে এর চাহিদাও ছিল অনেক বেশি। প্রতিটি পিস্তল বিক্রি করতেন ৩ লাখ টাকায়। এখন পর্যন্ত সাগর তার তিন সহযোগীর মাধ্যমে আটটি পিস্তল বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন।

এই কর্মকর্তা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ তারা এক বছর ধরে অস্ত্র তৈরি করে বিক্রি করছে। টানা এক বছরে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি ও বিক্রি করা সম্ভব। তাদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কেনা ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে। বিক্রিত অস্ত্র ও ক্রেতাদের গ্রেপ্তারে চলছে বিশেষ অভিযান। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ঢাকার প্রতিটি বাড়ি মালিক ও ভাড়াটিয়াদের সংশ্লিষ্ট থানার পক্ষ থেকে সরবরাহ করা ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম পূরণ করতে হয়। সেই ফরমে ভাড়াটিয়া সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য থাকে। অথচ সাগর ও তার সহযোগী তানভীরের বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব কিছু মানা হয়নি।

র্

যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে বলেন, খোদ রাজধানী ঢাকায় অস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপনের বিষয়টি সত্যিই অবাক করার মতো ব্যাপার। এমন ঘটনায় রীতিমতো হতবাক আমরা। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাড়ির মালিকদের আরও সচেতন হওয়া উচিত। অস্ত্র কারখানার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পুরো চেইনটি বের করার চেষ্টা চলছে।

সূত্র বলছে, ওই অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া আরও চারজন অনিক হাসান ও আবু ইফসুফ সৈকত চক্রের সদস্য। আর রাজু হোসেন ও আমির হোসেন অস্ত্রের ক্রেতা। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তাদের কাছে শতভাগ ব্যবহারের জন্য প্রস্তুতকৃত চারটি পিস্তল ছাড়াও চার রাউন্ড কার্তুজ, পিস্তলের ৭টি কাঠের ফর্মা, ১০টি ফায়ারিং ম্যাকানিজম, চারটি ট্রিগারসহ পিস্তল তৈরিতে প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। চক্রটির তৈরি করা অস্ত্রের ক্রেতাদের অধিকাংশই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও মাদক ব্যবসায়ী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে