বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের ছুটিতে চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা

হাসপাতাল বন্ধ থাকলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় না
পাঠান সোহাগ
  ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ঈদে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও সেবাদানকারী কর্মীদের একটা বড় অংশ থাকবে ছুটিতে -ফাইল ছবি

ঈদুল ফিতরের ছুটিতে রাজধানীসহ সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে রোগীরা। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী ও রোগীর স্বজনদের এমনিতেই স্বাভাবিক সময়েই নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এর ওপর ঈদে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও সেবাদানকারী কর্মীদের একটা বড় অংশ থাকবেন ছুটিতে। অল্প সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও সেবাদানকারী কর্মী দিয়ে চিকিৎসা সেব চালিয়ে নিতে হবে। এতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা তাদের প্রাপ্ত সেবা থেকে প্রতিবারই বঞ্চিত হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। এতে রোগীর স্বজনদের মধ্যে উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেছে। গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে রোগী ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, পবিত্র শবে কদর, ঈদুল ফিতর, বাংলা নববর্ষ ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালু থাকবে। ঈদের ছুটির কারণে রোগীদের উদ্বেগের কিছু নেই। চিকিৎসকরা যাতে রোস্টার অনুসারে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন, সে জন্য সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে ১২ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জরুরি বিভাগ ও ইনডোরে ঈদের ছুটির মধ্যে চিকিৎসা চলবে। আউটডোরও ঈদের পরদিন থেকে সীমিত আকারে খোলা রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব কিছু বিশেষ টিমের মাধ্যমে মনিটর করা হবে।

সরেজমিন গত বুধ, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি রোগী ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক রোগী ও স্বজনরা বাড়ি যাওয়ার

জন্য আকুল আগ্রহে বসে আছেন ছুটির অপেক্ষায়। আবার অরেকে হাসপাতালে একটু ভালো চিকিৎসার আশায়, রোগীকে বাঁচানোর তাগিদে হাসপাতাল ছাড়তে নারাজ। এছাড় গত কয়েক দিনে হাসপাতাল গলোতে আউটডোরে রোগীর সংখ্যা খুবই কম ছিল। ইতোমধ্যে আউটডোর সেবা বন্ধ হয়েছে এবং চিকিৎসকরা ছেড়ে গেছেন হাসপাতাল।

একাধিক সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও সেবা সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে চিকিৎসকদের আনাগোনা কম ছিল। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি শনিবার হাসপাতালের আউটডোর খোলা থাকে এর পরদিন রোববার সরকারি বন্ধ। সোমবার আবার খোলা থাকবে। এর পর মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার বার পর্যন্ত ঈদুল ফিতরের ছুটি থাকবে। এরপর শনিবার খোলা থেকে রোববার প্রহেলা বৈশাখের বন্ধ থাকবে। এই ১০ দিন হাসপাতালে সিনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে অনুপস্থিত থাকার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া জুনিয়র চিকিৎসক ও নার্সদের ঈদের ছুটি নেওয়ার প্রবণতা বেশি। এ নিয়ে হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পাবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন রোগী ও রোগীর স্বজনরা।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমাদের হাসপাতাল অনেক বড়। বিভিন্ন বিভাগ ভাগ করা আছে। আমাদের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কার কখন ছুটি লাগবে। কে কখন ডিউটি করবে। সবই আমার রমজান মাসের আগেরই রোস্টার করেছি। ঈদের ছুটি একই রোস্টারে চলবে। আমাদের রোগীর চিকিৎসা ব্যত্যয় ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই।'

সরেজমিন কথা হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৬৩৩ নম্বর ওয়ার্ডেও ৩ নম্বর শয্যার ভর্তি বরিশালের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অমিতের বাবা মো. শহিদুল সঙ্গে। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, গত ৬ মার্চ বাইক দুর্ঘটনায় আহত হলে ৭ মার্চ ঢাকায় এসেছি। চারদিন প্রাইভেট মেডিকেলের আইসিইউতে থাকার পর গত ১১মার্চ এ হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। ১ এপ্রিল ওয়ার্ডে দিয়েছে। এখনো রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। আরও কিছু দিন থাকতে হবে। হাসপাতাল বন্ধ থাকলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না, বাহির থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। এতে অনেক টাকা বেশি লাগে। বন্ধের দিন কোনো ডাক্তার আসে না, নার্সরাই দেখাশুনা করেন। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নোয়াখালীর লক্ষ্ণীপুর একালার সাফিয়া বেগম ৬ দিন আগে এইচডিইউতে ভর্তি হয়েছেন। রোগীর মেয়ে লিপি আক্তার নেহা যায়যায়দিনকে বলেন, শনিবারে অপারেশন হওয়ার কথা। অপারেশন হলে বুঝা যাবে, মায়ের কি কন্ডিশন। রোগী সুস্থ থাকলে হাসপাতালে ঈদ করতেও কোনো সমস্যা নেই। আমাদের মতো পরিবারের প্রাইভেট হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব না। এখানকার চিকিৎসায় আমরা খুশি। তবে ডাক্তারদের আরও সদয় হওয়া দরকার।

এছাড়া পঙ্গু হাসাপালে জরুরি ওয়ার্ডেও ২৮ নম্বর শয্যায় ভর্তি আছেন মাদারীপুরের শিবচরের মো. জুনায়েদ (১৬)। ২৫ দিন দিন আগে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জুনায়েদের বাবা জাহাঙ্গীর হাওলাদার যায়যায়দিনকে বলেন, গাছ থেকে পড়ে পায়ের উরুতে ভেঙ্গেছে। রোগী অবস্থা ভালো না। এখন অপারেশনের সিরিয়াল পাইনি। ঈদের আগে সিরিয়াল হবে বলে মনে হয় না। চিকিৎসা না করেও উপায় নাই। টাকার অভাবে প্রাইভেটি নিতে পাচ্ছি না। তিন দিনেও চিকিৎসকের দেখা পাই না। নার্স ছাড়া ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও পাই না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের আবাসিক সার্জন মে. আলাউদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, যে কোনো সকরারি হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের চিত্র ভিন্ন। ঢাকা মেডিকেলের মতো হাসপাতালে সবসময় ইমার্জেন্সি বিভাগে রোগী আছে। ইমার্জেন্সি বিভাগে যারা চাকরি করে তাদের ঈদ বলে কিছু নাই। রোস্টার অনুসারে ডিউটি করতে হয়। আমার স্টাফরা ঈদের আগে ও পরে সময় বণ্টন করে ছুটিতে যায়। এতে ইমার্জেন্সি বিভাগে কোনো প্রভাব পড়ে না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ঈদের সময় প্রায় সব হাসপাতালেই ইমার্জেন্সি ইউনিট ছাড়া আউটডোর সেবা কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ইনডোরের বেশির ভাগ চিকিৎসক ছুটি নেন। জরুরি বিভাগে এসে এখন যারা ইনডোরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হচ্ছেন, সেসব রোগীর চিকিৎসার জন্য শুধু জুনিয়র পর্যায়ের 'ডিউটি চিকিৎসক ও হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী চিকিৎসকরা থাকেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে মোট শয্যাসংখ্যা ১ লাখ ৭১ হাজার ৬৭৫টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে শয্যা আছে ৭১ হাজার ৬৬০টি এবং বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে শয্যা রয়েছে ৯৯ হাজার ৯৭৫টি। মোট শয্যা সংখ্যা ১ লাখ ৭১ হাজার ৬৭৫। এসব শয্যায় এক লাখের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। বর্তমানে দেশে সরকারি হাসপাতালে স্নাতক (এমবিবিএস) চিকিৎসক রয়েছেন ২৯ হাজার ৫৬১ জন। স্নাতক নার্সের সংখ্যা ৬ হাজার ৬৫০।

গত ৩১ মার্চ রোববার অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসানের সই করা এক অফিস আদেশে বলা হয়, এ বছর শবে কদর, ঈদুল ফিতর, বাংলা নববর্ষ ও সাপ্তাহিক ছুটির কারণে দীর্ঘ ছুটি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই ছুটির সময় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাপনায় কর্মরতদের ১২ দফা নির্দেশনা দেওয়া হলো। নির্দেশনায় বলা হয়, নিরবচ্ছিন্ন জরুরি চিকিৎসা কার্যক্রম ও জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে অনুকূলভাবে ছুটি মঞ্জুর করতে হবে। জরুরি বিভাগে সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি বিভাগ ও লেবার রুম, ইমার্জেন্সি ওটি সার্বক্ষণিক চালু রাখতে হবে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সগুলোর জরুরি ল্যাব, এক্স-রে সেবা সার্বক্ষণিক চালু রাখতে হবে। ছুটি শুরুপূর্বেই ছুটির সময়ের জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ, রি-এজেন্ট, সার্জিক্যাল সামগ্রী মজুত ও তাৎক্ষণিকভাবে সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে