বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

ইরানে ইসরাইলের হামলা

যাযাদি ডেস্ক
  ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ইরানের ইস্ফাহান শহরের একটি পারমাণবিক স্থাপনায় নিরাপত্তায় নিয়োজিত কয়েকজন সামরিক বাহিনীর সদস্য। ছবিটি শুক্রবার তোলা -ইন্টারনেট

ইরানের ইস্ফাহান প্রদেশে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। শুক্রবার ভোরে ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে দেশটির রাজধানী তেহরান থেকে সাড়ে তিনশ' কিলোমিটার দূরের এ প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা। ইস্ফাহানে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর অবস্থান। পাশাপাশি প্রদেশের নাতানজ শহরটি ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু। শুরু ইরানেই নয়, সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের দারা প্রদেশেও ইসরাইল হামলা চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। দু'জন মার্কিন কর্মকর্তা সিবিএস নিউজকে এমন তথ্য জানিয়েছেন। খবর বিবিসি ও রয়টার্স।

হামলার ঘটনার পর ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলছে, কয়েকটি শহরে বিমান চলাচল স্থগিত করা হয়। বেশ কিছুক্ষণ বন্ধ থাকার পর তেহরানের প্রধান বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা শুরু হয়। তিনটি ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে বলেও দাবি করেছে সংশ্লিষ্টরা।

ইরানিয়ান স্পেস এজেন্সির একজন কর্মকর্তা হোসেইন দালিরিয়ানের দাবি, সীমান্তের বাইরে থেকে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি। এক এক্স পোস্টে দালিরিয়ান লিখেছেন, 'ইসরাইল কয়েকটি কোয়াডকপ্টার (ড্রোন) ওড়ানোর ব্যর্থ এবং হাস্যকর চেষ্টা চালিয়েছে। ভূপাতিত করা হয়েছে কোয়াডকপ্টারগুলোকে।'

এদিকে, সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের দারা প্রদেশে সামরিক বাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করেও বিমান হামলা চালানো হয়েছে বলে দেশটির রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।

অন্যদিকে, ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা শুক্রবার সকাল থেকে তেল আবিবের সামরিক সদর দপ্তরে অবস্থান করছেন। গত শনিবার ইসরাইলি ভূখন্ডে আক্রমণের পর থেকেই দেশটির পাল্টা জবাবের হুঁশিয়ারিতে সর্বোচ্চ সতর্কতায় ছিল ইরান।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ইস্ফাহানেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। দেশটির অন্যতম বড় সামরিক বিমান ঘাঁটিও রয়েছে এখানে। প্রদেশের নাতানজ শহরটিকে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু বলা চলে।

তবে, 'নির্ভরযোগ্য সূত্রের' কথা উলেস্নখ করে দেশটির গণমাধ্যমগুলোর দাবি, পারমাণবিক স্থাপনাগুলো 'পুরোপুরি নিরাপদেই' আছে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আইআরআইবি জানিয়েছে, কয়েকটি মিনি ড্রোনকে প্রতিহত করতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়। এর ফলেই দেশের কয়েকটি অঞ্চলে প্রচন্ড শব্দ শোনা গেছে। ইস্ফাহান শহর নিরাপদ অবস্থায়ই আছে এবং বাসিন্দারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে বলেও জানিয়েছে রাষ্ট্রীয় এ সংবাদমাধ্যমটি।

বিবিসির জেরুজালেম থেকে মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা ইয়োলান্দ নেল জানাচ্ছেন, সপ্তাহের শুরুতে ইরানের হামলার পর সপ্তাহ শেষে ইসরাইলের পাল্টা হামলার মধ্য দিয়ে দু'দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা ছায়াযুদ্ধ বিপজ্জনকভাবে প্রকাশ্যে চলে এলো।

আর হামলার পর ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে রয়টার্সও জানায়, ইস্ফাহান, সিরাজ ও তেহরানের মতো বড় শহরগুলো থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চলাচল স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিল।

ইস্ফাহানের গুরুত্ব এবং কেন ইসরাইল বিমান হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্য হিসেবে স্থানটিকে বেছে নিতে পারে, সেই সম্পর্কে সাবেক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক কিমিট বিবিসিকে বলেন, 'ইস্ফাহান একরকম ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল। প্রশিক্ষণ, গবেষণা থেকে শুরু করে দেশটির পারমাণবিক সামর্থ্য বাড়ানোর সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় এখানে। সুতরাং, এটি ইসরাইলের হামলার একটি সম্ভাব্য জায়গা। কারণ ইসরাইলিদের সবচেয়ে বড় ভয় ইরানের বর্তমানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নয়, ভবিষ্যতে পারমাণবিক হামলার আশঙ্কা।'

ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি আইআরআইবি টেলিগ্রামে একটি ভিডিও পোস্ট করেছে। সেই ভিডিওতে একজন সংবাদদাতাকে ইস্ফাহান শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি ভবনের শীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।

তিনি বলেছেন, 'শহরটি নিরাপদ। মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। কয়েক ঘণ্টা আগে আকাশে শব্দ শোনা গিয়েছিল। আমরা যা জানি, তা হলো- ইস্ফাহানের আকাশে একাধিক মিনি-ড্রোন উড়ছিল। তখন সেগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।'

বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন এক বিশ্লেষণে বলেছেন, এমনকি এই পর্যায়ে এসেও যদি এই ঘটনাপ্রবাহ থামে, নতুন দৃষ্টান্ত কিন্তু স্থাপিত হয়েই গেল। ইরান সরাসরি ইসরাইলি ভূখন্ডে হামলা চালিয়েছে, জবাবে ইরানের ভূখন্ডে সরাসরি হামলা চালিয়েছে ইসরাইল, যা আগে কখনো ঘটেনি। ওই অঞ্চলে ইরান এবং ইসরাইলের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাতে দুই দেশের অভ্যন্তরে সরাসরি হামলা না চালানোটাই যেন 'রুলস্‌ অব দ্য গেম' (খেলার নিয়ম) ছিল এতদিন। এবার দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের ছদ্মবেশী সেই যুদ্ধ ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো।

ইউরোপিয়ান কমিশন আহ্বান

এদিকে হামলার ঘটনার পর চলমান উত্তেজনা যাতে আর না বাড়ে সেজন্য ইরান, ইসরাইল এবং তাদের মিত্রদের সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট আরসালা ফন দের লিয়েন।

ফিনল্যান্ডের ল্যাপেনরান্তা থেকে এক বিবৃতি তিনি বলেন, 'ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য সবপক্ষেরই আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকা জরুরি।'

পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরাইল 'বাজিয়ে দেখছিল'

ইসরাইল 'বাজিয়ে দেখছিল' বলে পশ্চিমা কর্মকর্তারা মনে করছেন যা বিবিসির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। ইরানের কেন্দ্রীয় প্রদেশ ইস্ফাহানের একটি সামরিক ঘাঁটিতে 'মাইক্রো ড্রোন' হামলার ঘটনার পর ইরানিরা সতর্ক হয়ে উঠেছে। গত ১৩ই এপ্রিল ইসরাইলের ওপর ইরানের অতর্কিত ড্রোন ও মিসাইল হামলার পর ইসরাইলের সম্ভাব্য প্রতিশোধের বিষয়ে ধারণা আছে, এমন ক'জন পশ্চিমা কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন, এটি কেবল 'প্রথম দফা'।

লেবাননের একজন পশ্চিমা কূটনীতিকের মতে, 'কৌশলটি হলো:সামান্য হামলার মাধ্যমে ইরানকে বড় পরিসরে পাল্টা হামলা করার জন্য উত্তেজিত করে তোলা।'

এদিকে, একজন পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তা জানান, সিরিয়া এবং ইরাক থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ড্রোন হামলার প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু ছিল জরুরি রাডার ব্যবস্থা।

তার মতে, 'ইসরাইল ইরান এবং তার মিত্র হিজবুলস্নাহর মতোই তারা প্রথমে রাডারগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। তাছাড়া, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর লক্ষ্য তৈরির পাশাপাশি তারা ইরানের রাডার সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে, যাতে দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দিতে না পারে।'

যুক্তরাষ্ট্র কোনো আক্রমণে সঙ্গে জড়িত নয় :মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

এদিকে ইরানে হামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবহিত ছিল কিনা বিবিসির এমন প্রশ্নের জবাবে জি সেভেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টিন বিস্ননকেন 'যুক্তরাষ্ট্র কোনো আক্রমণে সঙ্গে জড়িত নয়' এর বাইরে আর কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে 'যে কোনো সম্ভাব্য সংঘাত' এবং উত্তেজনা এড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও জি সেভেন উলেস্নখ করে তিনি জানান, ইসরাইল একটা 'নজিরবিহীন হামলার' শিকার হয়েছে এবং 'ইসরাইল যেন নিজেকে রক্ষা করতে পারে, এটা নিশ্চিত করাই' যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য।

বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক গার্ডনারের মতে, ইরানের গত শনিবারের ড্রোন এবং মিসাইল হামলার জবাব দেওয়ার বিষয়টি ইসরাইল আগেই স্পষ্ট করেছিল। সেই জবাব তারা দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

যদি সত্যিই এটা ইসরাইলের জবাবের শুরু এবং এটাই শেষ হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে হামলার আকার বা স্থান বিবেচনায় এই জবাব খুবই সামান্য।

একদিন আগেই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যামেরনকে বলেছিলেন, ইরানের হামলার জবাব কীভাবে দেওয়া হবে ইসরাইল 'নিজেই তার সেই সিদ্ধান্ত' নেবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে