বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দশ সমঝোতা স্মারক সই

শেখ হাসিনা-মোদি বৈঠকে ঢাকা-দিলিস্ন সম্পর্ক আরও জোরদারে মতৈক্য
যাযাদি ডেস্ক
  ২৩ জুন ২০২৪, ০০:০০
দশ সমঝোতা স্মারক সই
শনিবার নয়াদিলিস্নর হায়দরাবাদ হাউসে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি -ফোকাস বাংলা

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে ঢাকা ও নয়াদিলিস্ন। এসব স্মারকের মধ্যে সাতটিই নতুন। এছাড়া তিনটি সমঝোতা স্মারক নবায়ন করা হয়েছে।

শনিবার দিলিস্নর হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর এসব সমঝোতা স্মারক সই হয়।

1

দুই দেশের সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে সমঝোতা স্মারকগুলো স্বাক্ষরিত হয়।

দুই নেতার বৈঠকের আলোচনায় মূলত দুই দেশের মধ্যে সংযোগ, জ্বালানি, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সমুদ্র সম্পদ, বাণিজ্য, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন অংশীদারত্বের বিষয় স্থান পায়। পরে দুই দেশের মধ্যে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠক হয়।

এই বৈঠকের পর দুই নেতার উপস্থিতিতে সুনীল অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতা, রেল, সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সহযোগিতা, মৎস্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ ১০টি ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক সই হয়।

নতুন সাতটির মধ্যে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরভিত্তিক সুনীল অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা চুক্তি হয় দুই দেশের সরকারের মধ্যে।

সমুদ্রবিজ্ঞান এবং এ ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে আরেকটি সমঝোতা চুক্তি হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট (বিওআরআই) এবং কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাসট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর) ইন্ডিয়ার মধ্যে।

ভারত-বাংলাদেশ রেলসংযোগ বিষয়ক নতুন আরেকটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে।

টেকসই ভবিষ্যতের জন্য দুই দেশের মধ্যে ডিজিটাল ও সবুজ অংশীদারত্ব বিষয়ক নতুন দুটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে।

যৌথ কৃত্রিম উপগ্রহ প্রকল্পের জন্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল স্পেস প্রমোশন অ্যান্ড অথরাইজেশন সেন্টার (ইন-স্পেস), ডিপার্টমেন্ট অব স্পেস, ভারতের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নতুন সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের।

ডিএসসিসি, ওয়েলিংটন এবং ডিএসসিএসসি, মিরপুরের মধ্যে সামরিক শিক্ষা সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য নতুন একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়।

এছাড়া মৎস্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে সহযোগিতার তিনটি সমঝোতা স্মারক নবায়ন

হয়েছে এবার।

এদিকে টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে বাংলাদেশ ও ভারত এক সঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দিলিস্নর হায়দ্রাবাদ হাউসে শনিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা এ কথা বলেছেন।

\হবৈঠক 'ফলপ্রসূ' হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, "উভয় দেশ একটি 'রূপকল্প' অনুমোদন করেছে, যাতে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে দুই দেশই পরিচালিত হতে পারে। আমরা টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ডিজিটাল এবং সবুজ অংশীদারত্বের বিষয়ে একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে সম্মত হয়েছি।"

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়্‌সওয়াল এক্সে বলেছেন, শনিবার হায়দ্রাবাদ হাউসে শেখ হাসিনা পৌঁছালে তাকে অভ্যর্থনা জানান মোদি।

এরপর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী একান্ত বৈঠকে বসেন। পরে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। এরপর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে ঢাকা ও নয়াদিলিস্ন।

\হবৈঠক ও সমঝোতা স্মারক শেষে আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরতে সংবাদ সম্মলেন আসেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি।

শেখ হাসিনা বলেন, "দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, নিরাপত্তা ও বাণিজ্য সম্পর্কের বিষয়টি রয়েছে।"

ভারতকে বাংলাদেশের 'প্রধান প্রতিবেশী, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং আঞ্চলিক অংশীদার' হিসেবে বর্ণনা করে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বলেন, "ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে বাংলাদেশ অনেক মূল্য দেয়, যে সম্পর্কের সূচনা হয়েছে একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়।"

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক 'ক্রমাগত দ্রম্নত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে' বলেও মন্তব্য করেছেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, "আমাদের দুই পক্ষের বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে, যেখানে আমরা পারস্পরিক স্বার্থের অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছি। এসবের মধ্যে রাজনীতি ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও সংযোগ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, বিদু্যৎ ও জ্বালানি এবং আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছি"।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, "আমরা আমাদের জনগণ ও দেশের উন্নতির জন্য একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছি।"

যেহেতু নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে ঢাকা ও দিলিস্ন নতুনভাবে পথ-চলা শুরু করেছে, সে প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, "সেই ধারাবাহিকতায় আমরা 'রূপকল্প-২০৪১' এর মাধ্যমে 'স্মার্ট বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠা এবং 'বিকশিত ভারত-২০৪৭' অনুসরণ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছি।"

শেখ হাসিনা বলেছেন, দুই দেশ নিজেদের মধ্যে যেসব সমঝোতা স্মারক সই করেছে, সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি নবায়ন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, "সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উভয় দেশ উচ্চ পর্যায়ের সম্পর্ক বজায় রেখেছে।"

শেখ হাসিনা বলেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন এবং দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২০২১ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।

এছাড়া সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় সফরে ২০২২ সালে ভারত সফর করেন বলে জানান শেখ হাসিনা। এরপর গত বছর সেপ্টেম্বরে দিলিস্নতে অনুষ্ঠিত জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর পদে আসা শেখ হাসিনার এই মেয়াদে এটি ভারতে প্রথম আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় সফর।

এটি চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় ভারত সফর। দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ৮ থেকে ১০ জুন প্রতিবেশী দেশটি সফর করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, "আমি ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে এবং আমার প্রতিনিধিদলকে উষ্ণ আতিথেয়তা দেওয়ার জন্য। এগুলো আমাদের দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততার প্রমাণ।"

নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার এদিনের বৈঠকের কথা উলেস্নখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তারা দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পৃক্ততার উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন।

বিকালে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখারের সঙ্গে তার সচিবালয়ে শেখ হাসিনা সাক্ষাৎ করেন। পরে তিনি যান রাষ্ট্রপতি ভবনে। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি এই সমস্ত বৈঠক আমাদের দুই দেশের সহযোগিতা বৃদ্ধিতে আরও অন্তর্দৃষ্টি দেবে।"

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের সরকার ও জনগণের অবদানের কথাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, "আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাই ভারতের সেইসব বীরদের প্রতি যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।"

এই সফরের আমন্ত্রণের জন্য মোদি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের জন্য ফের আমন্ত্রণ জানান।

এদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজন করা হয় রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজের।

রাষ্ট্রপতি ভবনে সংবর্ধনা

এর আগে দিলিস্নতে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

শনিবার সকাল নয়টার দিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান মোদি।

বাংলাদেশের সরকারপ্রধানকে দেওয়া হয় লাল গালিচা সংবর্ধনা।

রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্টের একটি অশ্বারোহী দল রাষ্ট্রপতি ভবনের গেট থেকে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরকে সংবর্ধনাস্থল পর্যন্ত নিয়ে যায়।

পরে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। গার্ড পরিদর্শন এবং অভিবাদন গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। এ সময় দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীতও বাজানো হয়।

এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও তার সফরসঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দেন মোদির সঙ্গে।

এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, ভারতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার মো. মুস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার, বিদু্যৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ, রেলওয়ে সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবির, ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী, প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান, স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউলস্নাহসহ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীরা উপস্থিত ছিলেন।

মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা

রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে রাজাঘাটে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর (মহাত্মা গান্ধী) সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে যান শেখ হাসিনা। সেখানে পৌঁছালে রাজাঘাট সমিতির প্রধান শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান।

এরপর গান্ধীর সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। কিছুক্ষণ সেখানে তিনি নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।

এছাড়া সেখানকার পরিদর্শন বইয়েও স্বাক্ষর করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে