বৃষ্টিপাত কমে আসায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পস্নাবিত এলাকা থেকে পানি নেমে যাওয়ায় বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন আশ্রিতরা। তবে পানি নেমে গেলেও বাড়িঘরে জমেছে পালিমাটির স্তর। এতে বেড়েছে ভোগান্তি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে খাবার পানি ও ত্রাণের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। আর এমন দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী দুই দিন এই অঞ্চলে ফের ভারী বৃষ্টির আভাস দেওয়ায় ভয় কাটছে না বাসিন্দাদের। বন্যার কারণে সিলেট বিভাগের তিন বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এদিকে, দেশের উত্তরাঞ্চলে
আগামী ৭২ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ সময় বাড়তে পারে এই অঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি। এতে কুড়িগ্রামের একাংশসহ লালমনিরহাট ও নীলফামারীর নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে। এ ছাড়া রংপুরের নিম্নাঞ্চলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
সিলেট আবহাওয়া কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন জানান, শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত মাত্র দুই মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে আরও দুই-একদিন বৃষ্টিপাত হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, 'বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সিলেটে বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। তাই আমাদের ভয়টা কাটছে না।'
সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর জানান, নগরীর পস্নাবিত ওয়ার্ডগুলোর বেশির ভাগ স্থান থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। কয়েকটি ওয়ার্ডের কিছু স্থানে পানি রয়েছে। নগরীর আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষজন বাসা-বাড়িতে যাচ্ছেন। আর যাদের বাসার পানি নামেনি, তারা রয়েছেন।
আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বন্যার্তদের মধ্যে রান্না করা ও শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।
শুক্রবার রাতে সিলেট জেলা প্রশাসনের বন্যা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৩টি ও জেলার চারটি পৌরসভাসহ ১২০টি ইউনিয়ন পস্নাবিত রয়েছে। জেলার এক হাজার ৪৯৮টি গ্রাম পস্নাবিত রয়েছে।
জেলার ৩৬৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫ হাজার ২৭৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যাদুর্গত এলাকায় ৯ লাখ ৭৮ হাজার ২২৩ জন মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন।
এইচএসসি সমমান পরীক্ষা স্থগিত
বন্যা পরিস্থিতির কারণে সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা আগামী ৮ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে আগামী ৩০ জুন থেকে সারাদেশে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হলেও সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতে তা স্থগিত থাকছে।
বিজ্ঞপ্তির তথ্যানুযায়ী, ৯ জুলাই থেকে যথারীতি রুটিন মেনে সিলেট বিভাগসহ সারাদেশে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। যেসব জেলায় বন্যার কারণে ৮ জুলাই পর্যন্ত পরীক্ষা স্থগিত থাকবে, সেখানে এ সময় অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলো পরবর্তীতে নতুন রুটিনে নেওয়া হবে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকারের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় সিলেট বিভাগের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ড, সিলেট; বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন আগামী ৩০ জুন অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষাসমূহ ৮ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।
প্রকাশিত সময়সূচি অনুযায়ী ৯ জুলাই থেকে পরীক্ষাসমূহ যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে। আর স্থগিত পরীক্ষাসমূহের সময়সূচি পরবর্তীতে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উলেস্নখ করা হয়েছে, সিলেট বিভাগ ছাড়া মাদ্রাসা বোর্ড, কারিগরি বোর্ড ও অন্য সাধারণ আটটি বোর্ডের পরীক্ষাসমূহ প্রকাশিত সময়সূচি অনুযায়ী যথারীতি ৩০ জুন থেকে অনুষ্ঠিত হবে।
আমাদের সিলেট অফিস জানায়, কুশিয়ারা ছাড়া সিলেটের বাকি সব নদ-নদীর পানি ধীরে ধীরে কমছে। শুধু কুশিয়ার নদীর তিনটি পয়েন্টে পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নগরীর পানি কমেছে, ভেসে উঠছে রাস্তাঘাট। তবে উপজেলায় বন্যার্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণের জন্য হাহাকার দেখা গেছে।
সদর উপজেলার বাইশটিলা এলাকার বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। গবাদিপশু রাখার জায়গা নেই। চুলা নষ্ট হওয়ায় রান্নার সমস্যা হচ্ছে। এতে খাবার সংকট রয়েছে বানভাসি মানুষের। যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় ত্রাণ নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে মানবিক সংগঠনের লোকজনের।
সিলেটের বিশ্বনাথ এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেছেন প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনি জানালেন, বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের পাশে থাকবে তার সরকার।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় জানায়, বিকাল ৩টার দিকে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে এই নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে রয়েছে বিপৎসীমার নিচে।
একই সময় কুশিয়ার নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ১০২ ও শেরপুর পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
বকশীগঞ্জে নদী ভাঙন
বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, জামালপুরের বকশীগঞ্জে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ছে। নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে বকশীগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে।
পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি আইরমারী খান পাড়া, কতুবের চর, বাংগালপাড়া, পূর্ব কলকিহারা এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদী ভাঙনের ফলে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কুতুবের চর জামে মসজিদ, বসতভিটা, ফসলি জমি, গ্রামীণ রাস্তা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও কুতুবের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হুমকির মুখে রয়েছে। নদী ভাঙন অব্যাহত থাকলে যেকোনো সময় বিলীন হতে পারে এই বিদ্যালয়টি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) অহনা জিন্নাত জানান, কুতুবের চর গ্রামে নদী ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে পাঁচ শত জিও ব্যাগ বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আজ-কালের মধ্যেই ভাঙনকবলিত জায়গায় জিও ব্যাগ ফেলা হবে।
তলিয়ে গেছে দুধকুমার নদের তীর সংরক্ষণ বাঁধ
ভূরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, দুধকুমার নদের তীর সংরক্ষণ বাঁধ তলিয়ে গেছে। ফলে ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন ইসলামপুর ও নলেয়া গ্রামের তীরবর্তী জনসাধারণ।
সরাইলে দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দি
সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানান, বৃষ্টির পানিতে সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের ওবায়দুলস্নাহ সড়কের পাশে আমিনপাড়া গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। শনিবার সকালে সরেজমিন দেখা গেছে, স্থানীয় প্রভাবশালীরা শাহবাজপুর আমিনপাড়া এলাকায় পানি নিষ্কাশনের ড্রেনসহ বিশাল এরিয়া নিয়ে কৃষি জমিতে মাটি ভরাট করে হাউজিং প্রজেক্ট তৈরি করেছে। এই প্রজেক্টের পাশের সড়কের নিচে পানি নিষ্কাশনের ড্রেন রয়েছে। এই ড্রেনের সামনেও মাটি ভরাট করা হয়েছে। তাই কোনো কাজে আসছে না ড্রেন। বৃষ্টির পানি জমে এলাকার রাস্তাঘাট, বাড়িঘরসহ কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেজ-বা ঝউল আলম ভুঁইয়া জানান, তিনি বিষয়টি জেনেছেন এবং সমাধানের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।