জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান, তার দুই স্ত্রী ও সন্তানরা যাতে তাদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সরিয়ে নিতে না পারে এ জন্য মামলা দায়েরের আগেই তা ক্রোক বা জব্দ করা হতে পারে। মতিউরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তিন সদস্যের কমিটি এ ব্যাপারে জোরালো তৎপরতা শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দে কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় তিনি ও তার পরিবার তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেন। এছাড়া বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠজন ও সহযোগীরা খামার থেকে গবাদি পশু সরিয়ে নেওয়াসহ নানাভাবে স্থাবর সম্পদ হস্তান্তরের অপচেষ্টা চালান। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দুদক আদালতের মাধ্যমে এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সম্পদ তদন্ত চলাকালেই জব্দ করতে চান। একই সঙ্গে এসব সম্পদ কোনো অপকৌশলে যাতে বেহাত না হয় সেজন্য তা রক্ষণাবেক্ষণে দ্রম্নত তত্ত্বাবধায়ক বা রিসিভার নিয়োগ করারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
দুদকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, তদন্ত বা মামলার যেকোনো পর্যায়ে আদালত কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ দিতে পারেন। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ক্ষেত্রে মামলার আগে তদন্ত চলাকালেই আদালত থেকে সম্পত্তি জব্দের আদেশ হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ক্ষেত্রেও যাতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয় এজন্য আদালতে শিগগিরই আবেদন করছে কমিশন। কেননা মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানদের এরই মধ্যে যে বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে, তা কখনই বৈধভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই আইনি
প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রের অনুকূলে যাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সম্পদ বেহাত হয়ে গেলে রাষ্ট্র তা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান জানান, দুদক অভিযোগ পেয়ে কিংবা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে কারও বিষয়ে তদন্ত করতে পারে। আইন অনুযায়ী সেই তদন্তের সময়ই অনুসন্ধানকারীদের যদি মনে হয় ওই ব্যক্তির অবৈধ সম্পদ আছে এবং সেগুলো মামলা হতে হতে বেহাত হয়ে যেতে পারে, তাহলে তখনই অনুসন্ধানকারী ওই সম্পদ জব্দ করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন।
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, সাধারণত দুদক পত্রিকার খবরের ওপর ভিত্তি করে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। বরং কোন খবর আসলে সেটি তদন্ত করে তারা অগ্রসর হয়। তদন্ত কর্মকর্তারা যখন মনে করেন যে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যেতে পারে তখনই অবৈধ সম্পদ যেন সরিয়ে না ফেলতে পারে সেজন্য সম্পদ ক্রোকের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা হয়তো মনে করেছেন আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে ওই সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণে তারা আগেই আবেদন করতে পারেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত মতিউর রহমান ও তার দুই স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোনসহ নিকটজনদের নামে ছয় জেলায় ২ হাজার ১৪৫ শতাংশ জমি, আটটি ফ্ল্যাট, দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, দুটি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পটের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর বাইরে পুঁজিবাজারেও তার বিপুল অর্থ বিনিয়োগের তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক লায়লা কানিজের নামে। তার নামে প্রায় ২৮ বিঘা জমি ও পাঁচটি ফ্ল্যাট রয়েছে; এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরে একটি ভবনেই রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট।
মতিউরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন দুদক কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিকভাবে যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণ পাওয়া গেছে, তা ক্রোক করার জন্য আদালতে আবেদন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মতিউরসহ তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার বিষয়টিও থাকছে। পরবর্তী সময়ে আরও সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেলে সেগুলো জব্দ করার জন্য পৃথক আবেদন করা হবে।
ওই কর্মকর্তার ধারণা, যেভাবে মতিউর ও তার পরিবারের একের পর এক সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে নতুন করে আরও বিপুল পরিমাণ সম্পদের খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এজন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করলে এখন পর্যন্ত যে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে তা বেহাত হতে পারে।
তদন্তকারীদের ধারণা, মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানদের শুধু দেশেই বিপুল সম্পত্তি রয়েছে, তাই নয়; দেশের বাইরেও তাদের সমপরিমাণ সম্পদ থাকতে পারে। অনুসন্ধানে যা শিগগিরই বেরিয়ে আসবে। আইন অনুযায়ী ওইসব সম্পদও দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এদিকে দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, দেশেই মতিউরের আরও সম্পদ থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য দুদকে হস্তগত হয়েছে। এতে এ পরিবারের দুই ডজন ফ্ল্যাট থাকার উপাত্ত রয়েছে।
এর মধ্যে সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে ৮৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর পস্নটে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। সেখানেই মতিউর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজকে নিয়ে সপরিবারে বাস করতেন। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার থাকেন লালমাটিয়ার ৮ নম্বর রোডের ৪১/২ ইম্পেরিয়াল ভবনে। কাকরাইলেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ছোট স্ত্রীর নামে। এ ছাড়া ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে একাধিক ফ্ল্যাটের হদিস পাওয়া গেছে। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ডেভেলপার কোম্পানি শান্তা ডেভেলপারের করা বিভিন্ন ভবনে তার আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এসব ফ্ল্যাট প্রথম স্ত্রীর সন্তান ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে কেনা।
এ ছাড়া মতিউর সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে এফডিআর ও শেয়ারবাজারে নিজ নামে অর্ধশত কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। ছেলের ব্যবহৃত প্রাডো, প্রিমিও ও ক্রাউনের মতো চারটি বিলাসবহুল গাড়ি তার বিভিন্ন কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামের ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাকসেসরিজ কারখানা রয়েছে। যদিও কাগজে-কলমে কারখানার মালিক মতিউর রহমানের ভাই এম এ কাইয়ুম হাওলাদার। ময়মনসিংহের ভালুকায় ৩০০ বিঘা জমিতে গেস্নাবাল সুজ নামের দুটি জুতা তৈরির কারখানা রয়েছে। নরসিংদীর রায়পুরায় ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট রয়েছে। এসব রিসোর্টের মালিকানায় আছেন তার ছেলে ও মেয়ে। এ ছাড়া পূর্বাচলে আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পটের মালিকও মতিউর।
গাজীপুর সদর এলাকায় ১৭১ নম্বর এসএ দাগে ১০.৫০ শতাংশ, ১৭২ নম্বর এসএ দাগে ৩.৯০ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৭.৫০ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৬ শতাংশ, ১৭০ নম্বর এসএ দাগে ৬ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৭ শতাংশ এবং ১৭০ নম্বর দাগে ৬ শতাংশ জমি রয়েছে। এছাড়া সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৩০৩৫, ১৭৬৩ ও ১৭৬২ নম্বর দাগে ১২.৫৮ শতাংশ জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এই আটটি খতিয়ানে রয়েছে তার ৬০ শতাংশ জমি। স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৩৬৯৬ নম্বর এসএ দাগে ১৪.০৩ শতাংশ, গাজীপুরে ৪৮.১৬ ও ১৪.৫০ শতাংশ এবং ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ০.৪৫১৬২৫ একর জমি রয়েছে।
অভিজ্ঞ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মতিউর রহমান ও তার দুই স্ত্রী-সন্তানদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ মামলা দায়েরের আগে জব্দ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হলে তা যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থাতেই থাকবে। এরপর মামলার সিদ্ধান্ত হলে দুদক মামলা করবে এবং তারপর আবার তদন্ত হবে। তদন্ত শেষে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হলে চার্জশিট পাওয়ার পর আদালত অভিযোগ গঠন করবে। এরপর শুনানি হবে। শুনানিসহ সব ধরনের আইনি ধাপ শেষে আদালত যে আদেশ দেবেন তার ভিত্তিতে জব্দকৃত সম্পত্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি এই আদালতের আদেশে সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে যেতে পারেন।
এদিকে দুদক আদালতের মাধ্যমে মতিউর ও তার পরিবারের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বিপুল সম্পদ ক্রোকের উদ্যোগ নিলেও তা শেষ পর্যন্ত কতটা ইতিবাচক হবে তা নিয়ে অনেকে এখনো সন্দিহান। তাদের ভাষ্য, মতিউরের মতো ক্ষমতাবানদের পায়ে দুর্নীতির বেড়ি পড়ানো যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের। যা দুদকের পক্ষে গ্রহণ করা কতটা সম্ভব তা নিয়ে তারা সংশয় প্রকাশ করেন।
এ ধরনের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ বা প্রভাবশালী এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনের নির্মোহ প্রয়োগ হবে এটা ভাবা সহজ বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রে কী হয় সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
\হপ্রসঙ্গত, এনবিআর সদস্য ও কাস্টমস, এক্সাইজ এবং ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইবু্যনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত হয় ৪ জুন। এরপর একজন উপপরিচালককে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত দল গঠন করা হয়। তার বিরুদ্ধে গত দুই যুগে চারবার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ পৃথকভাবে অনুসন্ধান করে দুদক। প্রতিবারই দুদক থেকে অব্যাহতি পান তিনি।