বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বস্নগার নাজিম হত্যায় ৪ জঙ্গির বিচার শুরু

যাযাদি রিপোর্ট
  ২৫ জুন ২০২৪, ০০:০০
বস্নগার নাজিম হত্যায় ৪ জঙ্গির বিচার শুরু

আট বছর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র বস্নগার নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যায় পলাতক চাকরিচু্যত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়াসহ অভিযুক্ত চার জঙ্গির বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আদালত। আগামী ৬ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছেন বিচারক। আসামিদের মধ্যে আদালতে উপস্থিত ছিলেন দুইজন। বাকি দুইজন পলাতক।

সোমবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইবু্যনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ সময় আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন আসামি রশিদুন নবী ভূঁইয়া ওরফে রায়হান ও শেখ আবদুলস্নাহ। বিচারক নিয়মানুযায়ী অভিযোগ পড়ে শুনিয়ে তাদের কাছে তারা দোষী না নির্দোষ তা জানতে চান। আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচারের প্রার্থনা করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. নজরুল ইসলাম আসামি রায়হান, আরাফাত রহমান ও মোজাম্মেল হুসাইন সায়মনের অব্যাহতির আবেদন করেছিলেন আদালতে।

1

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, এ মামলার অপর দুই আসামি চাকরিচু্যত মেজর জিয়া নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সামরিক কমান্ডার বলে আইনশৃঙ্খলা

বাহিনীর দাবি। ছয় মামলায় মৃতু্যদন্ড মাথায় নিয়ে পলাতক রয়েছেন তিনি। অপর আসামি আকরাম হোসেনও পলাতক। আদালত বস্নগার নাজিম হত্যা মামলায় নাম আসা মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, মো. আরাফাত রহমান, ওয়ালিউলস্নাহ ওরফে ওলি ওরফে তাহের ওরফে তাহসিন, সাব্বিরুল হক চৌধুরী ওরফে আকাশ ওরফে কনিক ও মাওলানা জুনেদ আহাম্মেদ ওরফে সাব্বির ওরফে জুনায়েদকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়।

আদালতে ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির। তিনি জানান, এ মামলার অভিযোগপত্রের সাক্ষীরাও ১৬১ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে অব্যাহতি পাওয়া ৫ জনের দায় সম্পর্কে কিছুই বলেননি। এ জন্য বিচারক তাদের অব্যাহতি দেন।

কে এই নাজিম : সিলেটে গণজাগরণ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। ছিলেন সিলেট শাখা বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার তিলপাড়া ইউনিয়নের টোকাভড়াউট গ্রামে। পিতার নাম মরহুম আব্দুস সামাদ। পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন তিনি। ভাইদের মধ্যে চতুর্থ। বড় ভাই জুলহাস উদ্দিন মারা গেছেন। অন্য ভাইদের মধ্যে শামীম আহমদ ও সবার ছোট জসিম উদ্দিন যুক্তরাজ্য এবং সুনাম উদ্দিন ফ্রান্স প্রবাসী। মায়ের নাম তৈরন্নেছা। বোন পারুল বেগম ও নাসিমা বেগম।

নাজিমের লেখাপড়া : সিলেটের বিয়ানীবাজারের আসিরগঞ্জ দিশারী প্রি-ক্যাডেট স্কুল থেকে প্রাইমারি, পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন। আসিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেটের স্কলার্স হোম স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছিলেন। সিলেট লিডিং ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করেছিলেন এলএলবি অনার্স। প্রগতিশীল কর্মকান্ডের পাশাপাশি গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ছিলেন। সিলেটে পড়াশোনাকালীন নগরীর মজুমদারপাড়া এলাকায় একটি মেসে থাকতেন। পরবর্তীতে প্রাণনাশের আশঙ্কায় বহুবার থাকার জায়গা পরিবর্তন করেছিলেন। একপর্যায়ে জঙ্গিদের কারণে সিলেট ছাড়তে বাধ্য হন। ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলএম-এর সান্ধ্যকালীন কোর্সের ষষ্ঠ ব্যাচে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ঢাকার গেন্ডারিয়ার রজনীকান্ত চৌধুরী লেনের ২৯/ঘ নম্বর মেসের একটি কক্ষে সুনামগঞ্জের সোহেল নামের এক ছেলের সঙ্গে বসবাস করছিলেন।

যেভাবে হত্যা করা হয় নাজিমকে : ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল বুধবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। তখন রাত আনুমানিক ৯টা। তার সঙ্গে ছিলেন দুই বন্ধু সোহেল ও রাজীব। ঢাকার সূত্রাপুর থানাধীন একরামপুর মোড়ে পৌঁছেন তারা। এ সময় ২টি মোটর সাইকেলযোগে সেখানে হাজির হয় ৪ থেকে ৫ জন। মোটর সাইকেল থেকে তিনজন নেমে নাজিমের মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে। তার মাথার মগজ বেরিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে। রাস্তায় পড়ে থাকা নাজিমের মৃতু্য নিশ্চিত করতে হামলাকারীরা মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে দেয়। দ্রম্নত হত্যাকারীরা মোটর সাইকেলে করেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। হত্যার সময় হত্যাকারীরা 'নারায়ের তাকবির-আলস্নাহু আকবর' ধ্বনি দিয়ে নাজিমকে এলোপাতাড়ি কোপানো শুরু করে।

নাজিমের আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছে : গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকায় প্রাণনাশের আশঙ্কা করেছিলেন নাজিম। শিক্ষক, বন্ধু ও প্রিয়জনদের কাছে আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন। আজহারুল ইসলাম নামে নাজিমের এক শিক্ষক ওই সময় ফেসবুকে লিখেছিলেন, তোমার জন্য ভয় হয় নাজিম। একটু সাবধানে থেকো। দেখতেই তো পাচ্ছো কী হচ্ছে! জবাবে নাজিম লিখেছিলেন, 'ভয় আমার নিজেরও হয় স্যার। অকালে মরে যাওয়ার ভয়। কিন্তু কী করবো স্যার। মাথা নত করে চুপ করে বেঁচে থাকার চেয়ে এ মরণই বোধ হয় ভালো'।

আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার নাজিম হত্যার দায় স্বীকার : নাজিমকে হত্যার পর আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা একিউআইএস (আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট) এর বাংলাদেশ শাখা আনসার আল-ইসলাম হত?্যার দায় স্বীকার করে বলে জঙ্গি কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণকারী 'সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রম্নপ' তাদের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করে।

মামলা দায়ের : ঘটনায় পরদিন ৭ এপ্রিল সূত্রাপুর থানার এসআই মো. নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন।

চার্জশিট দাখিল : হত্যাকান্ডের ৪ বছর পর ২০২০ সালের ২০ আগস্ট ৯ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। চার্জশিটে প্রধান আসামি করা হয় চাকরিচু্যত ও ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গি সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়াকে।

বিচারিক কার্যক্রম : ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইবু্যনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র আমলে নেন। একই সঙ্গে পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় ওই বছরের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি পলাতক ৫ জনের সম্পত্তি জব্দের আদেশ দেন আদালত। সম্পত্তি ক্রোকের প্রতিবেদন প্রতিবেদন দাখিলের পর ওই বছরের ১০ মে আসামিদের আদালতে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দেন আদালত। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ২৫ জুলাই বিচারক অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন। কিন্তু কয়েক দফায় পেছানোর পর শেষ পর্যন্ত সোমবার নাজিম হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু হলো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে