গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ঢাকা মহানগরীর একটি করপোরেট হাউসে দুই দফা হামলার ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনী দ্রম্নত হস্তক্ষেপ করায় হামলাকারীরা ওই সময় তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। তবে এরপর থেকে দুর্বৃত্তরা অফিস কর্তৃপক্ষকে নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছে। এ ব্যাপারে দফায় দফায় চেষ্টা করেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে পারেননি। পরে ওই জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) এ ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি না করে লিখিত 'অভিযোগ' দেওয়ার পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ মেনে অভিযোগ দেওয়ার পর থানা পুলিশ তা গ্রহণ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রিসিভ কপি দেয়নি। কয়েক দফা ঘুরেও অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তা সংগ্রহ করতে পারেননি।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু ঢাকা মহানগরীতেই নয়, সারাদেশেই এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। যে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা থানায় গেলে এ ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। যদিও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য, পুলিশ যে কোনো অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। তবে এর আগে অভিযোগের সত্যতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করছে। যাতে নিরীহ কোনো মানুষ হয়রানির শিকার না হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে স্বার্থানেষী গোষ্ঠী নানা ধরনের অপতৎরতায় মেতে ওঠায় এ ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে বলে দাবি করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
তবে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, সারাদেশের থানাগুলো পুরোপুরি সচল হলেও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে দায়িত্ব পালনে কোনো রকম ঝুঁকি নিতে চাইছে না কেউ। এমনকি রুটিন কাজকর্মেও অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) কিংবা ছোটখাটো অভিযোগ গ্রহণের আগেও তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করছেন। উপরোস্থদের গ্রিন সিগন্যাল পেলে তবেই তা নথিভুক্ত করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, পুলিশ নিয়মমাফিক দায়িত্ব পালন করলেও কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে নারাজ। এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অনীহা প্রকাশ করছেন। যদিও অনেকেই প্রকাশ্যে অপারগতা প্রকাশ না করে তা কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ প্রকাশ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব
পালনের নির্দেশনা অমান্য করছেন।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়টি স্বীকার না করলেও পুলিশের মাঠপর্যায়ে যে প্রকৃত অর্থেই এ অবস্থা বিরাজমান, তা অনেকটাই স্পষ্ট। গত ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে পুলিশের গাড়িতে বিক্ষোভকারীদের হামলা এবং এ সময় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় এ বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।
এ ঘটনার সময় ওই গাড়িতে থাকা একজন পুলিশ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা হার্ডলাইনে গেলে বিক্ষোভকারীদের হামলা অনায়াসে প্রতিহত করতে পারতেন। কিন্তু কেউই সে ঝুঁকি নিতে চাননি। বরং নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কেননা, ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগে তাদের বিক্ষোভকারীদের ব্যাপারে 'সহনশীল' থাকার পাশাপাশি বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া অ্যাকশনে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, গত ২২ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টার পর আন্দোলকারীরা একপর্যায়ে ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা করলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও কিছু পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এ সময় আন্দোলকারীদের একটি অংশ পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে। এ সময় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে পুলিশ ভ্যানের ওপরও হামলা চালায় আন্দোলনকারীরা। এতে ভ্যানে থাকা পুলিশ সদস্যরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। হামলার মুখে কয়েকজন পুলিশ সদস্য অস্ত্র ফেলে চলে যান। পরে আন্দোলনকারীরা অস্ত্রগুলো সেনাবাহিনীর কাছে জমা দেন।
এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাকরাইলের অডিট ভবনের সামনে গ্রেড পরিবর্তনের দাবিতে অডিটরদের সড়ক অবরোধ কর্মসূচি ঘিরেও একই ধরনের চিত্র দেখা যায়। আন্দোলনকারীরা সেখানকার একটি সড়ক তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অবরোধ করে রাখলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় নির্দেশ দিয়েও পুলিশ সদস্যদের অ্যাকশনে নামাতে পারেননি। এ সময় কেউ কেউ প্রকাশ্যে নির্দেশনা মানতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অনেকে কৌশলে অ্যাকশনে নামা থেকে বিরত থাকেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু এই দুটি ঘটনাতেই নয়, যে কোনো আন্দোলন দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্ধর্ষ আসামি গ্রেপ্তারসহ সব ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালনেই পুলিশ এখন ভীষণভাবে অনাগ্রহী। পাশাপাশি সাধারণ দায়িত্ব পালনেও অতিমাত্রায় সতর্ক। তাই দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ দমন কার্যক্রমে দ্রম্নতগতি ফিরছে না। নাজুক এই পরিস্থিতিতে দেশে ছিনতাই, ডাকাতি, হামলা ও ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধ বাড়ছে। মাদক পাচারকারি ও ব্যবসায়ীরাও হয়ে উঠেছে বেপরোয়া।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো জোরাল ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেই অপরাধ চক্রগুলো সুযোগ নিচ্ছে। আবার নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, যা জনজীবনে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুলাইয়ের আন্দোলনের সময়ের ভূমিকার কারণে পুলিশ নৈতিক ও মনোবল সংকটে পড়ে অকার্যকর হয়ে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। আবার এখন সমালোচনা কিংবা বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার আশঙ্কায় অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না। এসব ক্ষেত্রে তারা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে।
যা আইনশৃঙ্খলার অবনতির অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পুলিশের এমন পরিস্থিতিতে পড়ার সুযোগ নিয়েছে দুটি গোষ্ঠী। এক, পেশাগত অপরাধীরা। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করছে যারা, ওইসব ব্যক্তিরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়া পুলিশের কাজের গতিহীনতা। এ ছাড়া সমালোচনা বা বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে তারা তাৎক্ষণিক অ্যাকশন নিতে পারছে না- 'যা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এনামুল হক সাগর জানান, মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সদর দপ্তর থেকে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশি কার্যক্রম গতিশীল করতে আইজিপি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
পুলিশের এই মুখপাত্র আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল এবং পুলিশ বাহিনী অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়েছিল। এ কারণে অপারেশনাল কার্যক্রম মারাত্মক ব্যাহত হয়েছিল। সেগুলো সামাল দিয়ে এখন পূর্ণোদ্যোমে কাজ করা হচ্ছে। কাজের মাধ্যমেই পুলিশ জনগণের আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনতে চায়। অপরাধ প্রবণতা ও কার্যক্রমও দ্রম্নত নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশ বা ডিএমপির মুখপাত্র তালেবুর রহমান বলেন, নগরীর সব থানা এবং পুলিশি কার্যক্রম এখন পুরোপুরি সক্রিয় ও কার্যকর হয়েছে। সে কারণে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটলেও কেউ অপরাধ করে রেহাই পাবে না। শিগগিরই পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির ধীরগতি এবং অপরাধীদের আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠা নিয়ে নগরবাসীর উদ্বেগের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার চিত্র এখন অনেকটাই স্পষ্ট। ঢাকা মহানগরীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুরসহ অধিকাংশ থানা এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ দিনেও ছিনতাই-ডাকাতি আতঙ্কে ভুগছে। বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে সব ধরনের অপরাধ কয়েকগুণ বেড়েছে বলেও দাবি করেন তারা।
শুধু অপরাধ দমনই নয়, মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের বিরুদ্ধেও পুলিশের নিয়মিত অভিযানও চলছে অনেকটাই দায়সারা গতিতে। ফলে নেতৃত্ব বদলে মাদক ব্যবসা নতুন করে জাঁকিয়ে বসেছে। মদ, গাঁজা থেকে শুরু করে আইসের মতো ভয়ংকর নেশাজাতীয় দ্রব্য সহজলভ্য হয়ে উঠেছে।
এদিকে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের দায়িত্ব পালনে ঝুঁকি নিতে অনীহা এবং অতি সতর্কতার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রম্নত উন্নতি হচ্ছে না, অনেকে এমন দাবি করলেও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, এই বাহিনীর প্রতিটি ধাপেই এখনো রদবদলের জোয়ার থামেনি। যে কারণে তাদের নিজেদের মধ্যেই স্থিতিশীলতা ফেরেনি।
খোদ পুলিশ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সক্রিয় করার চেয়ে বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বদলি বা পদোন্নতি নিয়ে। তাই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগছে।
ডিএমপির সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকা শহর অনেক ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে থানা ভেদে অপরাধের ধরনও ভিন্ন। ডিএমপিতে নতুন করে যাদের পদায়ন করা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগেরই ঢাকায় কাজের অভিজ্ঞতা নেই। আবার অনেকে কাজ করেছেন বিভিন্ন 'নন অপারেশনাল ইউনিটে'। তাই থানার দায়িত্ব পেয়েও তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না।