পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের নেপথ্যের মূল 'নায়কদের' খোঁজা হচ্ছে। যদিও ইতোমধ্যেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের অনেকেই বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় ঢাকার কাফরুল ও ভাষানটেক থানায় দায়েরকৃত পৃথক দুটি মামলায় ওই ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে অনেকেরই নাম। যাদের অনেকেই বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। ওইসব কুশীলবদের সম্পর্কে জানতে নজরদারিতে রয়েছেন শ্রমিক সংগঠনের বেশ কিছু শীর্ষ নেতা।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, খোদ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন কচুক্ষেত এলাকায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের উপর হামলা এবং বাহিনী দুটির যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা মোটেই কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। এমন ঘটনার নেপথ্যের ষড়যন্ত্র অনেক গভীরে বলে মনে করা হচ্ছে। নাশকতাকারীরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে শ্রমিক আন্দোলনকে পুঁজি করে ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। ঘটনা ঘটানোর পরপরই তারা শ্রমিকদের ছদ্মবেশে ভিড়ে মিশে যায়। যাতে তাদের শনাক্ত করা এবং আইনের আওতায় আনা কঠিন হয়।
সূত্রগুলো বলছে, চলতি বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই নানা ইসু্যতে সারাদেশে নানা ধরনের অঘটন ও সহিংসতা এবং নাশকতামূলক ঘটনা ঘটছে। ওইসব ঘটনা
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অন্য বাহিনীর সমন্বয়ে সামাল দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের জেরে সেনাবাহিনীর টহল গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা নতুন করে ভাবনার সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি বেশ কয়েক দফায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটলেও, সেনাবাহিনীর যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সেনা সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। এজন্য খোদ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন কচুক্ষেত এলাকায় দিন দুপুরে সেনাবাহিনীর গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সেনা সদস্যদের মনোবল ভেঙে দিতেই কোনো গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে কিনা প্রশ্ন ওঠেছে সে বিষয়েও।
পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশের উপর হামলা এবং যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মো. মাকছুদের রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, গত ৩১ অক্টোবরের ঘটনায় ঢাকার মিরপুর জোনের কাফরুল ও ভাষানটেক থানায় দুটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করেছে। মামলায় এজাহারনামীয় আসামি হিসেবে কারও নাম উলেস্নখ করা হয়নি। আসামিরা সবাই অজ্ঞাত। ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত চলছে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় ইতোম্েযধই ১ নভেম্বর শুক্রবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তিনি গ্রেপ্তারদের নাম প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তারদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাও আছেন। তারা ঘটনার সঙ্গে নানাভাবে জড়িত বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। সার্বিক তদন্ত ও পর্যালোচনায় ঘটনাগুলো নিছক দুর্ঘটনা বা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলেও মনে হচ্ছে না। ঘটনাগুলো অনেকটাই পরিকল্পিত হতে পারে। এমন পরিকল্পনার নেপথ্যের নায়কদের খোঁজা হচ্ছে। তাদের প্ররোচণায় বা উস্কানিতে মাঠ পর্যায়ে থাকা তাদের লোকজন হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। এজন্য শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে অনেকেই নজরদারিতে রয়েছেন। গ্রেপ্তার ও নজরদারিতে থাকা অনেকেরই অতীতেও এ ধরনের পরিকল্পিত নাশকতার সঙ্গে জড়িত থাকার রেকর্ড রয়েছে। গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ অক্টোবর ঢাকার মিরপুর-১৪ নম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন কচুক্ষেত এলাকায় বেতন-ভাতার দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন পোশাক শ্রমিকরা। শ্রমিকদের রাস্তা থেকে নিরাপদে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরা সদস্যরা। এতে বিক্ষোভকারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপর চড়াও হন। শ্রমিকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। ইটপাটকেলের আঘাতে বেশ কিছু সেনা ও পুলিশ সদস্য ছাড়াও পথচারী এবং বিক্ষোভকারীও আহত হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের রাস্তা থেকে বারবার সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকরা সেনাবাহিনী ও পুলিশের দুটি টহল গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ পুরো এলাকার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী নিয়মানুযায়ী প্রতি ৫ বছর পর পর নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে গার্মেন্টস কর্মীদের জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। সেই দিক বিবেচনা করে নতুন করে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ বকেয়া বেতন-ভাতার দাবি করছেন পোশাক শ্রমিকরা। তারই সূত্র ধরে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, কোনাবাড়িসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে আসছে।
সূত্র বলছে, সারাদেশে গার্মেন্টসের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। গার্মেন্টস সেক্টরে অরাজক পরিস্থিতি, বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ, তেল, গ্যাস, পানি, বিদু্যতের দাম বৃদ্ধির কারণে গোপনে অনেক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেছে। পোশাক শ্রমিকদের মাঠে নামিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা আগেও ছিল, এখনো আছে। এছাড়া দেশে থাকা বিদেশি গার্মেন্টস কারখানা যাতে বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হয়, এজন্য অন্তত ৪০টি শ্রমিক সংগঠনের শতাধিক গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা গোপনে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের মূল কাজই হচ্ছে দেশের উন্নয়নের প্রধান এই খাতকে দেশ থেকে সরিয়ে দেওয়া। গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করছেন অন্তত ৫০ লাখ শ্রমিক। দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের শিল্প পুলিশ ইউনিট চালু করা হয়। তাতেও অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। সবশেষ গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়া এবং ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে দেশের অনেক ছোটখাটো পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় এবং চাকরি হারানোর কারণে অন্তত ৫ লক্ষাধিক শ্রমিককে স্থায়ীভাবে গ্রামে চলে যেতে হয়েছে।