সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করতে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়।
মঙ্গলবার দুপুরে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গত রোববার পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তাজুল ইসলাম বলেন, 'তিনি (শেখ হাসিনা) যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের অভিযোগে অভিযুক্ত, তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেন্ডিং আছে, কিন্তু বাংলাদেশের জুরিসডিকশনের বাইরে তিনি চলে গেছেন, সে কারণে আন্তর্জাতিক পুলিশিং সংস্থা হিসেবে ইন্টারপোল যাতে তাকে গ্রেপ্তার করার ব্যবস্থা নেয় এবং তার ব্যাপারে অন্তত রেড অ্যালার্ট জারি করে, সেই ব্যাপারে আমরা অনুরোধ পাঠিয়েছি।'
এদিকে রোববার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, 'পলাতক ফ্যাসিস্ট চক্র পৃথিবীর যে দেশেই থাকুক না কেন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।'
ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির মাধ্যমে শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব কিনা সে বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা
যায়যায়দিনকে বলেন, বিষয়টি নানা হিসাব-নিকাষের ওপর নির্ভর করে। পলাতক আসামি বা আসামিরা যে দেশে অবস্থান করছে, সেই দেশের বিচারিক কর্তৃপক্ষ যদি তথ্য-প্রমাণাদির ওপর ভিত্তি করে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, আসামি বা আসামিদের গ্রেপ্তার করে সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত, তাহলে ইন্টারপোল চ্যানেলের মাধ্যমে আসামি বা আসামিদের গ্রেপ্তার করে সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠাতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আসামি বা আসামিরা যে দেশে অবস্থান করছেন, সেই দেশের সরকার এবং বিচারিক কর্তৃপক্ষের বিচার বিবেচনা বা রাজনৈতিক পলিসির ওপরও আসামিদের ফেরত পাঠানো হবে কি হবে না সেটিও অনেক সময় নির্ভর করে। এক্ষেত্রে আসামি বা আসামিরা যে দেশে অবস্থান করছেন, সেই দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিদের ওপরও আসামি বা আসামিদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নির্ভর করে। এ ছাড়া যে দেশে বা দেশগুলোয় আসামি বা আসামিরা অবস্থান করছেন, সেই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পারস্পরিক বা কূটনৈতিক সর্ম্পকও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে দায়িত্বশীল এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে কারও বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট বা রেড নোটিশ জারি করার আগে বেশকিছু নিয়মকানুন পালন করতে হয়। যাবতীয় প্রক্রিয়া দ্রম্নত শেষ করার চেষ্টা চলছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই শেখ হাসিনাসহ বিদেশে পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা রেড নোটিশ জারি করা হয়। মূলত ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করার অর্থ হচ্ছে অন্য দেশের পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সহায়তা চাওয়া। অর্থাৎ যার বা যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়, তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সদস্য দেশগুলো সহায়তা করে। অন্য দেশের পুলিশের সহায়তায় আসামিদের গ্রেপ্তার করে দেশে আনতেই মূলত এই নোটিশ জারি করা হয়ে থাকে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল শাখা সূত্রে জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল) একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ১৯৪টি দেশ বর্তমানে সংস্থাটির সদস্য। কারও নামে মামলা থাকলে সদস্য দেশের সরকারের তরফ থেকে ইন্টারপোলে প্রমাণাদি বা ডকুমেন্ট পাঠাতে হয়। ডকুমেন্ট যাচাই-বাছাই করে ইন্টারপোল। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে সংস্থা নোটিশ জারির প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তা নিশ্চিত করে। উপযুক্ত প্রমাণাদি থাকলে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করতে পারে। দুই ধরনের তথ্যাদি পাঠাতে হয়। যার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারির জন্য অনুরোধ করা হয়, সেই ব্যক্তির নাম, জন্ম তারিখ, জাতীয়তা, চুল, চোখের রং ও ছবি। একই সঙ্গে আঙুলের ছাপ পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে যদি পাওয়া যায় তাহলে পাঠাতে হয়। না পাওয়া গেলে না পাঠালেও কোনো সমস্যা হয় না নোটিশ জারির ক্ষেত্রে। এ ছাড়া যে অপরাধের জন্য আসামি বা আসামিদের সন্ধান করা হচ্ছে, সে সংক্রান্ত ও সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য থাকতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, অপরাধের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন বা সশস্ত্র ডাকাতির মতো অপরাধের ঘটনায় সাধারণত ইন্টারপোল কর্তৃপক্ষ রেড নোটিশ জারি করে থাকে। রেড নোটিশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে সন্ধান চাওয়া পলাতক ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সম্পর্কে ইন্টারপোলের সব সদস্য দেশের পুলিশকে একই সঙ্গে সতর্ক ও নোটিশ করা হয়। রেড নোটিশ পলাতকদের বিচারের আওতায় আনতে সাহায্য করে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হলে কখনো কখনো মূল অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বহু বছর পরও অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়।
সূত্রটি বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে থাকে ইন্টারপোল। এর সদর দপ্তর ফ্রান্সের লিয়োঁ শহরে। ইন্টারপোলের কাছে প্রত্যর্পণ, আত্মসমর্পণ বা এমন আইনি পদক্ষেপের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে এবং গ্রেপ্তার করার জন্য ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে। রেড নোটিশ হলো, এক ধরনের অনুরোধ। সদস্যভুক্ত কোনো দেশ এমন অনুরোধ করতে পারেন। তবে অনুরোধকারী দেশের বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা জারি করা আদালতের আদেশের ওপর ভিত্তি করে রেড নোটিশ জারি করা হয়।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল পুনর্গঠন করা হয়। ট্রাইবু্যনালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার। সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্টের বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা এবং দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
চলতি বছরের ১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। ট্রাইবু্যনাল শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের গ্রেপ্তার করে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে হাজির করার নির্দেশ দেন।
উলেস্নখ্য, চলতি বছরের জুলাইতে ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি ভারতে রয়েছেন বলে দেশটির তরফ থেকে নিশ্চিত করে জানানো হয়। যা পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তি আছে। যা ২০১৩ সাল থেকেই কার্যকর। পরে ২০১৬ সালে চুক্তিটিতে আরও পরিবর্তন আনা হয়। সেই চুক্তির আলোকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হয়নি। ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত চাওয়া হয়েছে।
দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, যদি শেখ হাসিনা ভারত থেকে অন্য কোনো দেশে চলে যান, সেই দিক বিবেচনা করেই শেখ হাসিনাসহ বিদেশে পলাতকদের গ্রেপ্তারের পর বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতেই ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ইন্টারপোলের মাধ্যমে বিদেশ থেকে মাত্র হালনাগাদ ১৭ আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে রেড নোটিশের তালিকায় বর্তমানে ৬৪ জন বাংলাদেশির নাম রয়েছে। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ ও হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি।