ঢাকা মহানগরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রতিবাদে মহাখালী, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, মিরপুর, রামপুরা, খিলগাঁও, সবুজবাগ ও মৌচাকসহ রাজধানীর অন্তত ১০টি স্পটে প্রধান সড়ক আটকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে চালকরা। এ সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে মহাখালীতে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সকাল ১০টার দিকে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা মহাখালী ও মালিবাগ রেলক্রসিংয়ে অবস্থান নেওয়ায় এবং আশপাশের ট্রেনলাইনের উপর রিকশা উল্টে রাখায় কমলাপুরের সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নগরীর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দীর্ঘসময় আটকে রাখায় সেখানকার তীব্র যানজটের প্রভাব চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে নগরীর জীবনযাত্রায় চরম স্থবিরতা দেখা দেয়।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়, শেরেবাংলা নগরের আগারগাঁও এবং নাখালপাড়া এলাকার প্রধান সড়ক অবরোধ করায় সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। কয়েক ঘণ্টা পর তারা অবরোধ তুলে নিলেও সেখানে আটকে থাকা গাড়ির চাপ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে যথেষ্ট বেগ পেতে হতে হয়।
মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ মাকছেদুর রহমান জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় কিছু রিকশাচালক জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে। পরে বিভিন্ন এলাকা থেকে খন্ড খন্ড মিছিল এসে সেখানে জড়ো হয়। এতে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হলেও বড় ধরনের কোনো যানজটের সৃষ্টি হয়নি।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুর ১৩ নম্বর থেকে মিছিল বের করে অটোরিকশা চালকরা। এরপর ১০ নম্বর গোলচত্বরে গিয়ে তারা সড়ক অবরোধের
\হচেষ্টা করলেও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেন। মিরপুর ১২ নম্বরের দিক থেকে আরেকটি মিছিল নিয়ে রিকশাচালকরা সেখানকার সড়কে বসার চেষ্টা করলেও সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদের সেখানে দাঁড়াতে দেয়নি। এ সময় চালকরা মেট্রোরেল স্টেশনের নিচের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নানা ধরনের স্স্নোগান দেয়।
এদিকে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা মোহাম্মদপুরের বসিলার চৌরাস্তায় নেমে সড়ক অবরোধ করে। এতে আশপাশের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মালিবাগেও বিক্ষোভে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীরা। আশপাশের এলাকায়ও চরম বিপর্যয় দেখা দেয়। মৌচাক-মগবাজার সড়কে সৃষ্টি হয় যানজট। তবে একপর্যায়ে পুলিশ এসে আশ্বাস দিলে রাস্তা ছেড়ে যায় অবরোধকারীরা।
স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা। এর এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি ও আশপাশের কয়েকটি জায়গায় ভাঙচুর করা হয়। পরে তারা রেললাইনের দিকে সরে গিয়ে সেখানে বেশ কয়েকটি রিকশা উল্টে রাখে। এ সময় সেনাবাহিনী তাদের ধাওয়া দিলে রিকশাচালকরা তাদের লক্ষ্য করে রেললাইনের পাথর ছুঁড়তে থাকে।
ঘটনাস্থলে থাকা কয়েকজন গণপরিবহণ যাত্রীর কাছ থেকে জানা যায়, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দেড় থেকে দুই হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক মহাখালী মোড়ে জড়ো হয়ে সড়ক অবরোধ করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সরে যেতে বললেও তারা অনড় থাকে। তারা মহাখালীতে রেললাইনে বসে পড়ায় বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচলও। তবে ছয় ঘণ্টা অবরোধের পর বেলা সোয়া ৩টার দিকে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা মহাখালী রেললাইন ও পাশের সড়ক থেকে সরে যায়।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার রুহুল কবীর খান বিকালে বলেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশ বুঝিয়ে বেলা সোয়া ৩টার দিকে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সরিয়ে দিয়েছে।
এর আগে ঢাকা জেলা রেলওয়ে পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত কমলাপুর থেকে কোনো ট্রেন ঢাকার বাইরে ছেড়ে যায়নি এবং ঢাকার বাইরে থেকে কোনো ট্রেন কমলাপুরে পৌঁছায়নি। এতে ট্রেনের সিডিউল লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ায় যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
মহাখালী রেললাইনের পাশাপাশি সংলগ্ন সড়ক অবরোধ করায় ঢাকার বাইরে ছেড়ে যাওয়া এবং বাইরে থেকে ঢাকায় আসা দূরপালস্নার বাসগুলো দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়ে। এতে যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন। এই অবরোধের প্রভাবে রাজধানীর গুলশান, খিলগাঁও, বাড্ডা ও মেরাদিয়া যেতে যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়।
রাজধানীর মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা মুগদার বাসিন্দা জাহানারা বেগম জানান, তিনি সকাল ৯টার দিকে সেখানে এসেছিলেন। ১০টার মধ্যেই ডাক্তার দেখানো শেষ হওয়ার পর কোলের শিশু নিয়ে রাস্তায় নেমে চরম বিপাকে পড়েন। কোন যানবাহন না পেয়ে অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়ি এলাকায় এসে সিএনজি অটোরিকশায় চড়েন। তবে রামপুরা পার হতেই ফের ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের আন্দোলনের মুখে পড়েন। সেখান থেকে কয়েক দফা রিকশা পাল্টে ও হেঁটে তাকে বাসায় ফিরতে হয়েছে।
এদিকে বসিলা চৌরাস্তা অবরোধ করায় গাবতলী থেকে আমিনবাজারের দিকে যেতে পারেননি কেউ। মোহাম্মদপুর থেকে কেরানীগঞ্জের দিকে যাওয়ার সেতুও সকাল থেকে দুপুর অবদি দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল। এসব রাস্তায় চলাচলকারী সাধারণ মানুষ, স্কুলগামী শিক্ষার্থী, বিভিন্ন বয়সি ব্যক্তি, রোগী- সবাইকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
বসিলায় অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ব্যাটারিচালিত রিকশা চালক আবুল খায়ের বলেন, আগের সরকার এই রিকশা বৈধ করার পর অনেক মানুষ নতুন করে এই পেশায় এসেছেন। অনেকেই ঋণ করে রিকশা কিনেছেন। এখন যদি হঠাৎ করে এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে হাজার হাজার মানুষ বিপদে পড়বেন। তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে ব্যাটারি রিকশা বন্ধ করা হলে তাদের অন্ততঃ সহায়-সম্বল বাঁচবে- যোগ করেন তিনি।
এদিকে আগারগাঁও মেট্রোরেল স্টেশনের কাছের চৌরাস্তা সকাল ৯টা থেকেই আটকে দিয়েছিলেন ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা। তবে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাস্তা ছাড়েন তারা। এ সময় এপিবিএনের সদস্যদের এলাকায় দেখা যায়। তারা চালকদের সঙ্গে কথা বলেন।
আগারগাঁওয়ে জাহিদুল আলম নামের এক ব্যবসায়ী জানান, তিনি পলস্নবী থেকে নয়াপল্টন যাচ্ছিলেন। তবে দীর্ঘ যানজটে প্রায় এক ঘণ্টা আটকে থাকার পর তিনি বাস ছেড়ে পায়ে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদে এ ধরনের হুটহাট সিদ্ধান্ত না নিয়ে দীর্ঘ পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের অবরোধে মৌচাক-মালিবাগ মোড় থেকে তিন দিকে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। সকাল থেকে দফায় দফায় আন্দোলন চলতে থাকে। সর্বশেষ দুপুর পৌনে ১টার দিকে রাস্তায় কাঠ ও টায়ার জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে বৃহস্পতিবার মৌচাক মার্কেটে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ক্রেতা ছিল না। এ সময় আন্দোলনকারীরা মৌচাকের কয়েকটি দোকানের সাটার ভেঙে ফেলে। কয়েকজনকে সাটার নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
মৌচাক মোড় থেকে মগবাজার ওয়্যারলেস, রাজারবাগ ও শান্তিনগরের তিন পাশেই রিকশা, প্রাইভেট কার ও গণপরিবহণের দীর্ঘ সারি জমে ওঠে। অন্যদিকে রামপুরা ব্রিজ এলাকায় আন্দোলনের কারণে মৌচাক ফ্লাইওভারেও তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় দুর্ভোগে পড়েন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। রিকশাচালকদের অবরোধে মালিবাগ ফ্লাইওভার থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় এ সড়কের যাত্রীদেরও চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।