বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন

মধ্যরাতে সচিবালয়ে আগুন

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে মধ্যরাতে আগুন লাগার ঘটনায় বিভিন্ন মহলে জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। এই অগ্নিকান্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা ধরনের আলোচনা চলছে
যাযাদি রিপোর্ট
  ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মধ্যরাতে সচিবালয়ে আগুন
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে বুধবার মধ্যরাতে আগুন লাগে ১০ ঘন্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস -স্টার মেইল

বাংলাদেশ সচিবালয় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুরক্ষিত দপ্তর। সেই দপ্তরের ৭ নম্বর ভবনে বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে আগুন লাগে। ৬ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে ১৯টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। আর সেই আগুন পুরোপুরি নিভতে সময় লেগেছে প্রায় ১০ ঘণ্টা। এদিকে, প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে মধ্যরাতে আগুন লাগার ঘটনায় বিভিন্ন মহলে জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। বুধবার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর পদত্যাগ দাবি করে রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে প্রতিবাদ সভায় আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন আমলারা। প্রশাসনে এমন চলমান অস্থিরতার মধ্যেই ওইদিন রাতেই এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলো। এই অগ্নিকান্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। রাষ্ট্রের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় গভীর রাতে আগুন লাগার কারণ নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন সন্দেহের কথা বলেন। আগের সরকারের 'দুর্নীতির প্রমাণ নষ্ট করতে' আগুন লাগানো হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ। এছাড়া এটি নাশকতা, না-কি স্বাভাবিক অগ্নিকান্ড-এ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। এই আগুনকে অন্তর্বর্তী সরকারকে 'ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্র' হিসেবে দেখছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লেখেন, 'স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থলোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখনো জানা যায়নি। আমাদেরকে ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না।' অন্যদিকে ফ্যাসিস্টদের পক্ষে 'সিমপ্যাথি গেইন' ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে উলেস্নখ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুলস্নাহ বলেছেন, 'এই ক্যাম্পেইন না থামাতে পারলে আপনি শেষ। আজকে আমলা আগামীকাল অন্য কেউ।' তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ফ্যাসিজমের এনাবলারদের বিরুদ্ধে অন্তর্র্ব‌তী সরকারের উদারতা দেখানোর পরিণাম এই কপালপোড়া জাতিকে অনন্তকাল ভুগাবে। হাসিনার (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) ঘি খাওয়া ফ্যাসিস্ট এনাবেলররাই এখন মানবাধিকারের আলাপ দিয়ে ফ্যাসিস্টদের পক্ষে 'সিমপ্যাথি গেইন' ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। এই ক্যাম্পেইন না থামাতে পারলে আপনি শেষ। আজকে আমলা আগামীকাল অন্য কেউ। সচিবালয়ে অগ্নিকান্ডের পর এমন মন্তব্য এলো তার কাছ থেকে। আগুন পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়েছে বলে মনে করেন সচিবালয়ের কাছে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, 'যে আগুনটা লেগেছে, সুনিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন এটা সুপরিকল্পিত।' এর আগে সকাল পৌনে ৭টার দিকে সচিবালয়ের সামনে ব্রিফিংয়ে আসেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। তিনি বলেন, 'রাত ১টা ৫২ মিনিটে আমরা মেসেজ পাই সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লেগেছে। ১টা ৫৪ মিনিটের মধ্যে আমাদের ইউনিট সেখানে পৌঁছে। ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়িগুলো ঢুকতে না পারায় কাজে বেগ পেতে হয়েছে। ৬ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস।' সচিবালয়ের যে ভবনটি আগুনে পুড়েছে, তার ১০টি তলায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অফিস রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ; পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর রয়েছে সেখানে। কারণ খুঁজতে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি এদিকে, অগ্নিকান্ডের উৎস ও কারণ উদঘাটনের পাশাপাশি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তদন্ত কমিটিকে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহ্বায়ক করে গঠিত এই কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক অফিস আদেশে বলা হয়েছে, সংঘঠিত অগ্নিকান্ডের উৎস ও কারণ উদঘাটন, পেছনে কারো ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায় আছে কিনা তা উদঘাটন এবং এ জাতীয় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তদন্ত কমিটিকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ছাড়াও ঢাকা মহানগর পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং গৃহায়ন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের তদন্ত কমিটিতে রাখা হয়েছে। 'নাশকতা কি না, তদন্তের পর বলা যাবে' প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের আগুনের পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা নাশকতা দেখছেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, 'এটা ইনভেস্টিগেশনের আগে আমি তো বলতে পারব না। ইনভেস্টিগেশনের পরে আপনাদের আমরা জানাব।' সচিবালয়ের মতো এতো সুরক্ষিত জায়গায় কীভাবে অগ্নিকান্ড ঘটল, এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, 'অ্যাক্সিডেন্ট তো সব জায়গায় হতে পারে, এজন্য তো অ্যাক্সিডেন্ট বলে। সচিবালয়ের ভেতরেও তো হতে পারে। এজন্য তো সচিবালয়ের ভেতরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি রাখা হয়।' এর আগে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল ব্রিফিংয়ে বলেন, 'সচিবালয়ের আগুন লাগার কারণ সম্ভবত ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন ছিল। এক জায়গা আগুন ধরলে বিদু্যৎ লাইনের মাধ্যমে সব জায়গা ছড়িয়ে পড়ে। এটা হতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক কারণ এখনও আমরা বের করতে পারি নাই। আগুন নেভানোর পর আমরা যখন সব জায়গা তলস্নাশি করব, তখন আপনাদেরকে বলতে পারব।' আগুনের উৎসের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস কিছু জানিয়েছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এটা তদন্তের পরে বলা যাবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, 'এ ঘটনায় আমাদের একজন ফায়ার ফাইটার নিহত হয়েছেন। তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। একটা পাইপ নিয়ে সচিবালয়ের দিকে আসছিলেন, রাস্তা পার হচ্ছিলেন, এ সময় একটা ট্রাক তাকে ধাক্কা দেয়। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে পর মারা যান। এছাড়াও আরও দুই তিনজন সামান্য আহত হয়েছেন।' 'সচিবালয়ের আগুনে সবাই উদ্বিগ্ন' সচিবালয়ের মতো 'সুরক্ষিত' জায়গায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সবাই 'উদ্বিগ্ন' বলে মন্তব্য করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। বৃহস্পতিবার ক্ষতিগ্রস্থ ভবন পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, 'যখন আগুন লেগেছে তখন অফিস বন্ধ ছিল, এতো সুরক্ষিত জায়গায় আগুন লেগেছে- যা সবাইকে উদ্বিগ্ন করেছে।' বুধবার গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের চেষ্টায় ১০ ঘণ্টা পর সেই আগুন নেভানো সম্ভব হয়। ফারুক ই আজম বলেন, 'উপরের জায়গাগুলোতে করিডোরে অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক অফিস ক্ষতি হয়েছে। আগুনে চারটা ফ্লোরে ক্ষতি হয়েছে।' আগুনের কারণ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'এখন এ কথা বলা যাচ্ছে না। তদন্ত না হওয়ার আগে বলা যাচ্ছে না। এজন্য তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আশা করছি, পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর জানতে পারব- কেন আগুনটা লেগেছে।' গুরুত্বপূর্ণ নথি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ফারুক ই আজম বলেন, 'এখনই বলা যাচ্ছে না। পুরাটা ওপেন করা হয়নি।' সচিবালয়ের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। উষ্মা প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'সচিবালয়ের ভেতরে একশ থেকে দেড়শ সিকিউরিটি গার্ড থাকে। আগুন লাগার পর কি একজনেরও চোখে পড়েনি। এটা কীভাবে সম্ভব।' 'মনে হচ্ছে অগ্নিকান্ড পরিকল্পিত' এদিকে, প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড 'পরিকল্পিত' বলে মনে হয়েছে অগ্নি নির্বাপণে অংশ নেওয়া নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তার। নৌবাহিনীর সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম বলেছেন, 'শর্ট সার্কিট থেকে নয়, এটা পরিকল্পিতভাবে হয়ত আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।' বৃহস্পতিবার দুপুরের আগে সচিবালয় থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের একথা বলেন তিনি। আমিনুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের মনে হয়েছে শর্ট সার্কিট থেকে নয় পরিকল্পিতভাবে লেগেছে। মনে হল বিভিন্ন জায়গা থেকে হয়েছে। শর্ট সার্কিট হলে একটা জায়গা থেকে হয়। এক জায়গা থেকে নয়, এটা হয়েছে কয়েকটা জায়গা থেকে।' ওই ভবনের ভেতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে নৌবাহিনীর সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার আমিনুল সাংবাদিকদের বলেন, 'ভেতরের সব নথিপত্র পুড়ে গেছে। যেখানে যেখানে আগুন গেছে সব জায়গায় পুড়ে গেছে।' উলেস্নখ্য বুধবার গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের চেষ্টায় ১০ ঘণ্টা পর সেই আগুন নেভানো সম্ভব হয়। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ৬, ৭, ৮, ৯ এই চারটি তলা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম তলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি, সেখানকার অধিকাংশ নথি পুড়ে গেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে