ছাত্র-জনতার গণঅভু্যত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গভীর সংকটে পড়ে জনপ্রশাসন। এরপর নানা পদক্ষেপে আওয়ামী লীগের সাজানো দলীয় প্রশাসনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। এতে শীর্ষ পর্যায়ে বড় পরিবর্তন, পদোন্নতির হিড়িক, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের নিরবচ্ছিন্ন দাবি-দাওয়ার আন্দোলন, অনভিজ্ঞতায় চরম বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে প্রশাসন।
সবশেষ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাব ঘিরে উত্তাল প্রশাসন। স্বাভাবিকভাবেই কাজেকর্মে নেমেছে স্থবিরতা। প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন আগামী বছর প্রশাসনের সামনে সংকট কাটিয়ে গতি ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও আমলারা জানান, গণঅভু্যত্থানের সাড়ে চার মাসেরও বেশি সময়ে শৃঙ্খলা ফেরেনি প্রশাসনে। আগস্টের বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তরণে যতটুকু আশা জেগেছিল, তা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশের কারণে ভেস্তে গেছে। বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্যে শেষ হচ্ছে ২০২৪ সাল।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থাকা কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়েছে। এখনো সেই প্রক্রিয়া চলছে। তাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে, পাঠানো হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরে, পদায়ন করা হচ্ছে কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে চার মাসে ২৩ জন কর্মকর্তারাকে সচিব করা হয়েছে। ১৭ জন কর্মকর্তা গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। অতিরিক্ত সচিব ১৩৫, যুগ্ম-সচিব ২২৮ এবং উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৩৪ জন। ১৪টি মন্ত্রণালয়ে সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চুক্তিতে।
আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে পদোন্নতি ও পদায়ন করতে নানা ধরনের ত্রম্নটি-বিচু্যতি হচ্ছে। অনিয়মে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা পদোন্নতি
পেয়েছেন। বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সচিব কিংবা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে, যা সমালোচনার সৃষ্টি করছে। এজন্য ভুলগুলো শুধরে বারবার সিদ্ধান্ত বদলাতে দেখা যাচ্ছে প্রশাসনে। নীতি-নির্ধারণী পদের কর্মকর্তাদের অনভিজ্ঞতা সংকটকে আরও গভীর করেছে। অন্যদিকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ায় পদোন্নতি যোগ্য কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে হতাশ ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে।
ডিসি নিয়োগ কেন্দ্র করে বিপুল অর্থের লেনদেনের অভিযোগ করে গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানের বিরুদ্ধে। যদিও কমিটি সিনিয়র সচিবের অর্থ লেনদেনে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পায়নি।
অন্যদিকে, জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে নজিরবিহীন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন কর্মকর্তারা। ডিসিরা হাতাহাতিতেও জড়ান। নিয়োগ নিয়ে হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা করায় ১৭ জন উপসচিবকে শাস্তির সুপারিশ করে এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি।
দাবি আদায়ে আনসার কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের সচিবালয় ঘেরাও করে রাখার কর্মসূচির মুখোমুখিও হতে হয়েছে প্রশাসনকে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বঞ্চনা নিরসনে সাবেক অর্থসচিব ও বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী জাকির আহমেদ খানকে আহ্বায়ক করে গত ১৬ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত দাবি করে এক হাজার ৫৪০ জন এ কমিটির কাছে আবেদন করেন। এর মধ্যে ৭৬৪ জনকে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করেছে কমিটি।
২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়া চলমান থাকার সময় এ বঞ্চিত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন সচিবকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন, তাদের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান বলেন, 'গত ৫ আগস্টের পর যখন রেজিম পরিবর্তন হলো, সবাই চেষ্টা করেছে এটার একটা সুযোগ নেওয়ার। প্রশাসনেও তাই হয়েছে। তিনদিনের মধ্যে তিনটি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যিনি সিনিয়র সহকারী সচিব ছিলেন তিনি তিনদিনের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব হয়ে গেছেন। এটা অন্যদের মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি করেছে যে এটা আমরাও পারি। সেটাই কন্টিনিউ হয়েছে। সবাই মনে করেছে ঘেরাও করতে পারলেই কিছু একটা পাওয়া সম্ভব। পুরো প্রশাসনে আমরা এখনো সেটা দেখছি।'
গত ৩ অক্টোবর আট সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশনের প্রধান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা করে তুলতে এ কমিশন গঠন করা হয়। ৯০ দিনের (৩ মাস) মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবেন।
গত ১৭ ডিসেম্বর সচিবালয় বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী জানান, উপসচিব পুলে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রেখে অন্য ২৫ ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগ এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে সিভিল সার্ভিস থেকে আলাদা করার সুপারিশ করা হবে।
বর্তমান বিধিমালা অনুযায়ী, উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ এবং অন্য সব ক্যাডারের ২৫ শতাংশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়।
সংস্কার কমিশনের এ খসড়া প্রস্তাব ঘিরে উত্তাল প্রশাসন। বিশেষ করে প্রভাবশালী প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন। প্রশাসন ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারাও এর বিরোধিতা করছেন। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা এর প্রতিবাদ জানিয়ে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবি জানিয়েছেন। উপসচিব পদে পদোন্নতির কোটা কমানোর প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ৬৪ জেলার ডিসি।
কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের 'আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ'। পরিষদ কর্মবিরতি, মানববন্ধনের সঙ্গে সমাবেশের ডাক দিয়েছে।
এ পর্যায়ে এসে সংস্কার কমিশনের তাদের খসড়া সুপারিশগুলো শেয়ার করা প্র্যাকটিক্যাল হয়নি বলে মনে করি। তারা জানেন যে একটা দ্বন্দ্ব কিন্তু অনেক দিন ধরে চলে আসছে। তাই তাদের চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করা বাস্তবধর্মী হয়নি। তারা তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সুপারিশগুলো দিতে পারতেন।- অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান
প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনও (বিএএসএ) আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। গত ২২ ডিসেম্বর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নজিরবিহীনভাবে জমায়েত করেছেন সচিবালয়ে। ২৫ ডিসেম্বর প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে তারা কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, 'সংস্কারের এ বিষয়গুলো এ মুহূর্তে কি খুব দরকারি ছিল? এখন নির্বাচন নিয়ে লোকজন ব্যস্ত। নির্বাচন কবে হবে, কীভাবে নির্বাচনটাকে সুন্দর করা যায়ৃ ভয়হীনভাবে মানুষ ভোট দিতে পারবে। এটা হলো মূল। এখন এটা মূল এজেন্ডা নয়।'
তিনি বলেন, 'সংস্কার প্রয়োজন, আমরা ৫৪ বছরে কোনো সংস্কার আনিনি। তবে এটা চলমান প্রক্রিয়া। দেড়-দুই বছরের মধ্যে এ সরকার সব সংস্কার করে ফেলবেন এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তাই এখন নির্বাচনমুখী সংস্কারগুলো বেশি প্রয়োজন।'
অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান বলেন, 'এ পর্যায়ে এসে সংস্কার কমিশনের তাদের খসড়া সুপারিশগুলো শেয়ার করা প্র্যাকটিক্যাল হয়নি বলে মনে করি। তারা জানেন যে একটা দ্বন্দ্ব কিন্তু অনেক দিন ধরে চলে আসছে। তাই তাদের চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করা বাস্তবধর্মী হয়নি। তারা তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সুপারিশগুলো দিতে পারতেন।'
প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বছরে (২০২৫ সাল) প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোই হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। বিগত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতার আলোকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে নতুন করে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি না হয়।
দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনেই সময় কাটছে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়া দূরের কথা। রুটিন কাজও ঠিকভাবে চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। বিঘ্নিত হচ্ছে সেবা প্রদান প্রক্রিয়া। শিগগির এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করা না গেলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গণঅভু্যত্থানের পর নানা সংকটের মধ্য দিয়ে প্রশাসন এগোলেও এর মধ্যে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ এসেছে। চাকরিপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। সর্বোচ্চ বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩২ বছর করে অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। এতদিন সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাধারণ প্রার্থীদের সর্বোচ্চ বয়স ৩০ এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ৩২ বছর ছিল।
এছাড়া বিসিএসসহ সব ধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষার আবেদন ফি সর্বোচ্চ ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর 'বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা, ২০১৪' সংশোধন করা হয়।
একই সঙ্গে বিসিএসে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ২০০ থেকে কমিয়ে ১০০ করা হয়েছে। এখন থেকে বিসিএসে ১০০০ নম্বরের পরীক্ষা হবে, আগে ১১০০ নম্বরের পরীক্ষা হতো।
দেশের সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে হবে। একই সঙ্গে উপদেষ্টাদেরও সম্পদের হিসাব দিতে হবে। এজন্য একটি নীতিমালাও করা হয়েছে।
২৫ ডিসেম্বর দিনগত রাতে সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুন লাগে। এতে সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনের ৬ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত চারটি ফ্লোর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ছাই হয়ে যাওয়া চারটি ফ্লোরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পলিস্ন উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ছিল।
প্রশাসনে চলা অস্থিরতার মধ্যে এই আগুন নানান বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। সবমিলিয়ে নতুন বছরে প্রশাসনের চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন করে তুললো বছর শেষের এ আগুন।