প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য ও পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল স্বাভাবিক রাখার জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চারটি বিভাগের ৩১টি জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয়ে এই নির্দেশ দেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা এই ভিডিও কনফারেন্সে কর্মকর্তাদের নিজ নিজ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, সার সরবরাহ ও শিল্প এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কর্মকর্তারা এই ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দেন। কনফারেন্সে ১৯ জন বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ পুলিশপ্রধান, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার পর্যায়ের কর্মকর্তা বক্তব্য দেন।
কনফারেন্সে সমাপনী বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও মতামত আগামী দিনে সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে। তিনি আরও বলেন, 'এটা আমার জন্য প্রথম সুযোগ ছিল, আপনাদের সঙ্গে কথা বলার। অনেক কিছু শিখলাম, অনেক বিষয়ে নিজেকে অবহিত করলাম। এটা আমাদের কাজে সহায়ক হবে।'
ড. ইউনূস বলেন, 'সামনেই রমজান আসছে। রমজানকে কেন্দ্র করে বাজারমূল্যের দিকে আপনারা বিশেষভাবে নজর রাখবেন। শুধু বাজারমূল্য নয়, জিনিসপত্র আনা-নেওয়া আরও কীভাবে সহজ করা যায়, সে বিষয়েও কাজ করবেন।'
সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার যে ১৫টি কমিশন গঠন করেছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি কমিশন খুব শিগগির তাদের প্রতিবেদন দেবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এসব প্রতিবেদনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে। নাগরিকদের সঙ্গেও আলোচনা হবে। এর মধ্য দিয়ে দেশে নির্বাচনের একটি আবহও তৈরি হবে।
প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া কী হবে, সে বিষয়ে সচেতন থাকার জন্য মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা, যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করা যায়।
এদিকে, নতুন বছরে শৃঙ্খলভাবে যাতে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়, সেই নির্দেশনা মাঠ প্রশাসনকে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সবার অধিকার নিশ্চিতের নির্দেশনাও দিয়েছেন সরকার প্রধান।
ড. ইউনূস বলেছেন, 'বই বিতরণ হবে, সেটা নিয়ে না কথা উঠবে। কেউ বই পেল না। উপরের থেকে বই বিতরণের যে ব্যবস্থা আছে- সেটা যদি প্রপার নাও হয়, বই ঠিক মতো আসেনি, কেউ পেয়েছে কেউ পায়নি; কিন্তু নিজের মতো করে, সবার সঙ্গে আলাপ করে সুন্দর শৃঙ্খলবদ্ধভাবে ঠিক করে রাখলে, জানিয়ে রাখলে- তারাও শান্ত থাকে। কিন্তু অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলে মানুষ একটু ক্ষুব্ধ হয়।'
ছেলে-মেয়েরা বই পাচ্ছে না এমন উদ্বেগ থেকে অনেকের মনে দ্বন্দ্ব, অশান্তির সৃষ্টি হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'সেই অশান্তি নিরসনে আমাদের নিয়ম মেনে (বই বিতরণ) করতে হবে। নিয়ম মেনে দিলে মানুষ মানতে চায়, নিয়ম না থাকলে যত বিপদ। আমরা যেন নিজেরা নিয়মের ভেতরে থাকি, মানুষকেও জানাই- "আমরা নিয়মের মধ্যে আছি"।'
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই দিন বাদে শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা করে। এরপর সোমবারই প্রথম মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা, যাতে অংশ নেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কর্মকর্তারা।
পুলিশের মনোবল বাড়ার বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, 'একটা বিষয় আমাদের প্রায় আলাপ হয় শান্তিশৃঙ্খলার বিষয়ে। পুলিশের ভূমিকা- তারা মনোবল হারিয়েছে, যেহেতু তাদের উপরে অনেক অভিযোগ। অভু্যত্থানের সময় যে ভূমিকা তারা পালন করেছে, সেজন্য তাদের উপর মানুষের ক্ষোভ। কাজেই তাদের মনোবল বৃদ্ধি, যারা দোষী- তাদের অবশ্যই শাস্তি হবে। যারা নির্দোষ, তারা যেন নিশ্িছদ্রভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে।'
গণঅভু্যত্থানের পর পরিবর্তনের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা যাতে কাজে প্রতিফলন হয়, সেই নির্দেশনাও প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, 'কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব রয়েছে, নাগরিক হিসাবেও দায়িত্ব রয়েছে; একটা বড় পটপরিবর্তন হয়েছে। বড় পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগটা যদি আমরা না বুঝি, তাহলে বোধ হয় আমরা ব্যর্থ হলাম। এই যে পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, উপর থেকে নির্দেশনার পাশাপাশি নিজের থেকে সম্প্রসারিত করতে হবে- 'এ পরিবর্তনটা আমরা চাই'। এটা কোনো নির্দেশের বিষয় নয়, অনুধাবন করার বিষয় আমরা এ ভঙ্গিতে কাজে প্রতিফলন করব।'
ইউনূস বলেন, 'যেহেতু অভু্যত্থান হয়েছে, তার মধ্যে বহু ধরনের ডিস্টার্বনেন্স সৃষ্টি হয়েছে কাজে-কর্মে। কাজেই এটা থেকে উত্তরণ করে আমাদের ফুল স্পিডে অগ্রসর হওয়ার সময় এসে গেছে। যেহেতু বছরের শেষ অর্ধ সময় কাটালাম, নতুন বছর শুরু হচ্ছে। নতুন বছরের কর্মপ্রেরণা পূর্ণভাবে ধারণ করে আমরা কাজগুলো করব; মানুষ যেন বোঝে একটা পরিবর্তন হয়েছে।'
সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, 'মানুষ চায়- শান্তি শৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। সেটাতে আমরা খুব গুরুত্ব দিচ্ছি। সব মানুষ যেন মনে করে, সরকার আমাদের অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত করেছে। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবার অধিকার নিশ্চিত করতে চাই।'
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশিদ। তিনি জানান, শিগগিরই প্রধান উপদেষ্টা বাকি চার বিভাগের ৩৩টি জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে একই ধরনের ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দবেন।