টানা তিন দিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সূর্যের দেখা মেলেনি বললেই চলে। পৌষের শীতের হিমেল হাওয়া কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার পর শনিবার সকালে ঝলমলে রোদ উঁকি দিয়েছে। এতে স্বস্তি ফিরেছে নগরজীবনে। এদিকে, দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তাপমাত্রা শুক্রবারের তুলনায় কিছুটা বাড়লেও বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। এদিন ৯.৪ ডিগ্রি রেকর্ড হয়েছে। আর ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ ডিগ্রি। এদিকে তাপমাত্রা নেমে যাওয়ায় সারাদেশে বিপাকে পড়েছেন হতদরিদ্র থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ।
এদিকে কনকনের শীতের মাঝেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির আভাস দেখছে আবহাওয়া অফিস। সংস্থাটি বলছে, এ সময় কমবে রাত ও দিনের তাপমাত্রা।
শনিবার সকাল ৯টায় জেলার তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। যা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্রনাথ রায়।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, দেশের উত্তর অঞ্চলের আট জেলার মধ্যে হিমালয়ের অতি নিকটবর্তী হওয়ায় পঞ্চগড়ে সবচেয়ে বেশি শীত অনুভূত হয়। প্রতিবছরই এমন আবহাওয়া বিরাজ করে। আর যখনই হিমেল হাওয়া জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যায় তখনই তাপমাত্রার পারদ হ্রাস পেতে শুরু করে।
তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। সে হিসাবে এ এলাকার ওপর দিয়ে কয়েকদিন ধরে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত পুরো জেলা ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকছে। সেই সাথে উত্তরের হিম শীতল বাতাসে শীতের তীব্রতা বাড়ায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে অনেকেই।
জেলা সদরের মিরগর এলাকায় পাথর ভাঙা শ্রমিক মর্জিনা বেগম বলেন, এই কনকনে শীতের মধ্যে কাজ করা যাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের খোঁজ-খবরও নেয় না কেউ, এই সময়টাতে যদি শীতবস্ত্র দিয়ে কেউ সহযোগিতা করতো তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো।
বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের দিনমজুর হোসেন আলী ও আলাউদ্দিন বলেন, তিন-চারদিন ধরে কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাসের কারণে শীতটা মনে হচ্ছে অনেক বেড়েছে। শীতের কারণে ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। গরম কাপড় নাই। এখনও সরকারি বা বেসরকারি কোনো কম্বল পাই নাই। খুব কষ্টে আছি।
তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা এলাকার পাথর শ্রমিক জুয়েলসহ কয়েকজন বলেন, 'তিন-চার দিন ধরে ভোর থেকে ঘন কুয়াশা। কুয়াশার সঙ্গে ঝরঝর করে বৃষ্টির মতো শিশির পড়ছে আর ঠান্ডা বাতাস বইছে। এমন পরিস্থিতিতে নদীতে পাথর তুলতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু কি করবো, পরিবারের কথা চিন্তা করেই পাথর তুলতে হচ্ছে। দিনশেষে জ্বর-সর্দির মতো রোগে ভুগতে হচ্ছে আমাদের।'
এদিকে বেড়েছে শীতজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্তের পরিমাণ। প্রতিদিনই জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগে জ্বর, সর্দি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসা নিতে ভিড় করছেন।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্রনাথ রায় বলেন, 'শনিবার পঞ্চগড়ে দেশের সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। শুক্রবার একই সময়ে তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।'
অন্যদিকে, টানা তিন দিন পর সূর্যের উত্তাপ পেয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। শনিবার সকালে রোদ উঁকি দেওয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।
গত তিন দিন ধরেই প্রায় দিনভর রাজধানী ছিল কুয়াশার চাদরে ঢাকা। দিনভর ঠান্ডা হাওয়ায় ভুগতে হয়েছে বাইরে খেটে খাওয়া মানুষ আর সকাল-সকাল অফিসগামী যাত্রীদের।
রাজধানীর মহাখালী এলাকার রিকশাচালক মো. রাসেল বলেন, 'আইজ অন্যদিনের চাইয়া সকালে একটু শীত কম। এই কয়দিন ঠান্ডা আর কুয়াশায় কাবু হইয়া গেছি। রিকশার হ্যান্ডেল ধইরা রাখতেও কষ্ট হইছে। রাইতেও তাড়াতাড়ি গাড়ি বন্ধ করছি। কষ্টই হইছে কয়দিন।'
মহাখালীতে আইসিডিডিআর'বির সামনের চা দোকানি জামাল হোসেন বলেন, 'এই দুই-তিনদিন অনেক ঠান্ডা পড়ছে। সকালে তো দোকানই খুলতে পারি নাই। আজ আবার সকালে রোদ উঠায় দোকান খুলছি।'
কয়েকদিনের শীতে বিক্রি বেড়েছে শীতবস্ত্রের। এই এলাকায় ফুটপাতে শীতবস্ত্র বিক্রেতা মো. জিহাদ বললেন, 'এই কয়েকদিন বেচাবিক্রি একটু ভালো হয়েছে। আসলে শীত কম পড়লে তো আর মানুষ শীতের জামাকাপড় কিনতে চায় না।'
রাজধানীর সাতরাস্তা এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে আফজাল হোসেন বলেন, 'আমি সাধারণত সকাল আটটায় অফিসের জন্য বের হই; রাত আটটায় ফিরি। এই দুই-তিন দিন সকালে বের হয়ে খুবই কষ্ট পেলাম শীতে।'
শীতের দাপট কমবে, তাপমাত্রা বাড়বে
আগামী ২ দিনে কুয়াশা কেটে শীতের দাপট কমবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে দিনে এবং রাতের তাপমাত্রা বাড়বে।
আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা শনিবার সকালে বলেন, 'ঢাকায় তো ইতোমধ্যেই রোদ উঠে গেছে আজকে। ৫ তারিখ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত রোদ থাকতে পারে। তবে, এই সময়ে উত্তরাঞ্চলে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। ঢাকায় সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এরপর ৮ তারিখের দিকে ফের তাপমাত্রা কমতে পারে।'
আবহাওয়া অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, শনিবার সকালে ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। আর, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং তা কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত থাকতে পারে।
ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বুলেটিনে জানিয়েছে, এই সময়ে সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে সারাদেশের কোথাও-কোথাও দিনের বেলায়ও শীতের অনুভূতি বিরাজমান থাকতে পারে বলে বুলেটিনে জানানো হয়েছে।
বর্তমানে দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে উলেস্নখ করে আবহাওয়া বিভাগ জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়; সেখানে তাপমাত্রার পারদ নেমেছে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
এছাড়া, যশোরে ১১ ডিগ্রি, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ১১ দশমিক ৪ ডিগ্রি, নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নথিবদ্ধ করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই সময়ে দেশের অধিকাংশ স্থানেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২০ ডিগ্রির নিচে।
এছাড়া এই সময়ে রাজধানী ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল টেকনাফে; ২৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শীতের মধ্যেই বৃষ্টির আভাস
এদিকে, কনকনের শীতের মাঝেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির আভাস দেখছে আবহাওয়া অফিস। শনিবার আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মলিস্নক জানিয়েছেন, বর্ধিত পাঁচদিনের আবহাওয়ার শুরুর দিকে দেশের উত্তরাংশে হালকা বৃষ্টি ও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হতে পারে। এ সময়ের শেষের দিকে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পারে।
তিনি জানান, বর্তমানে উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, এর বর্ধিতাংশ উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।
এ অবস্থায় রোববার (৫ জানুয়ারি) সকাল পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। রাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং তা কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নদী পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে সারাদেশের কোথাও কোথাও দিবাভাগে শীতের অনুভূতি বিরাজমান থাকতে পারে।