চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, 'আমরা বারবার করে বলছি যে, নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নাই। এটা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে ইম্পোর্টেন্ট বিষয়। আমরা মনে করি যে, এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাই-অগাস্টের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। এই কারণে আমরা সরকারকে আহ্বান জানাতে চাচ্ছি, নির্বাচন কমিশনকেও আহ্বান জানাচ্ছি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও আহ্বান জানাচ্ছি- দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই বছরের মাঝামাঝি সময়েই মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।'
মঙ্গলবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ফখরুল। সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে বিএনপির পক্ষ থেকে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, 'বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সোমবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ছিল যে, এই বছরের শেষের দিকে অথবা পরবর্তী বছরের অর্থাৎ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি যে, এত বিলম্বিত করার কোনো কারণ নেই। আমরা মনে করি যে, যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে এবং মোটামুটি একটা স্ট্যাবেলিটি এসেছে গভর্নেন্সের মধ্যে, সেই ক্ষেত্রে এই নির্বাচন (জাতীয় নির্বাচন) অনুষ্ঠানের জন্য মনে হয় যে- এই মাসে আগামীকাল সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনের রিপোর্ট এসে যাবে। সুতরাং মনে হয় না- আরও বিলম্বিত করার কোনো কারণ আছে। যত বিলম্ব হচ্ছে, ততই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে।'
গত বছরের বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে ধারণা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছিলেন, 'ভোট কবে হবে তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে কতটা সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়া হবে, তার ওপর। মোটাদাগে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে হতে পারে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন।'
'সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নয়'
জাতীয় নির্বাচনের পরে স্থানীয় সরকার করার পক্ষে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান তুলে ধরার একদিন বাদে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছেন ফখরুল। তিনি বলেছেন, 'জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা আগে সংসদ নির্বাচন চাই।'
গত রোববার ইসির বৈঠক শেষে কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউলস্নাহ বলেছিলেন, কমিশনের সামগ্রিক ফোকাস জাতীয় নির্বাচন। সেদিকে এগোচ্ছেন তারা।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করা নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা শুরু হয়েছে। 'বেশির ভাগ মানুষ চান আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক', নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদের এমন বক্তব্য দেওয়ার পর এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
এর মধ্যে শনিবার জাতীয় নাগরিক কমিটি গণঅভু্যত্থানের পর স্থানীয় সরকার কাঠামো 'ভেঙে পড়ায়' নাগরিকরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছে মন্তব্য করে বলেছে, 'এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিস্থিতি আছে।'
তার আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে সরকার।
এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, 'স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হচ্ছে- জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ এখন তো ফোকাসটা পুরো দেশের, পুরো জাতির হচ্ছে- এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উপরে। ক্রাইসিসটা ওই জায়গাতেৃগত তিনটা জাতীয় নির্বাচন হতে পারেনি, মানুষ সেজন্য তারা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে গণতন্ত্র উত্তরণের পথ- সেটাকে তারা পূরণ করতে চায়। আপনাদের বুঝতে হবে, লোকাল গভর্মেন্ট দেশ চালায় না, দেশ চালায় কিন্তু জাতীয় সংসদ; আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ, গণতন্ত্রের মূল বিষয়টা হচ্ছে জাতীয় সংসদ-এটা কার্যকর হলে গণতন্ত্র ফাংশনাল হয়।'
বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'এরকম ক্রিটিক্যাল সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া অন্য নির্বাচন করার চিন্তাটা আসে কোত্থেকে? নির্বাচন পেছানোর চিন্তাটাই বা আসে কোত্থেকে? কারণ এটা তো আপনার প্রথম কাজ। আপনি দেশকে যদি একটা লাইনে- রেললাইনের উপরে তুলতে চান তাহলে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নাই। সংস্কার তো আছেই- চলমান প্রক্রিয়া; আমরাই তো সংস্কার আগে তৈরি করেছি, আগে জাতির কাছে উপস্থাপন করেছি- সেই ২০১৬ সালে আমরা 'ভিশন-২০৩০' দিয়েছি, ২০২৩ সালে ৩১ দফা দিয়েছি। আমরাই তো সবচেয়ে বেশি সংস্কার করেছি।'
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, 'লোকাল গভর্মেন্টের তৃণমূল স্তর হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। সেই ইউনিয়ন পরিষদই তো সরকার বাতিলই করে নাই। সেটা যদি বাতিল না করে, সেখানে কীভাবে লোকাল গভর্মেন্ট নির্বাচন হবে?'
'নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুত'
মির্জা ফখরুল বলেন, 'নির্বাচনের জন্য কতগুলো ফরমেলেটিজ আছে- যেমন ভোটার লিস্ট, এই ভোটার লিস্ট রেডি। ভোটার লিস্ট হালনাগাদে বেশি দিন লাগার কথা নয়, এক মাসের মধ্যেই আপনার যদি কেউ হালনাগাদ করতে চায়- সেটা করতে পারবে। এরপরে প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগসহ বিভিন্ন কাজ এক-দুই মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সবই তো তৈরি। "নির্বাচন কমিশন বলেছে যে, নির্বাচন করার জন্য আমরা রেডি" এবং তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার জন্য তৈরি আছে। তারা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে যে, দুইটা নির্বাচন এক সাথে সম্ভব না। সুতরাং এটা জাতির স্বার্থে প্রয়োজন এই নির্বাচনটা (সংসদ নির্বাচন)।'
'আগের চেয়ে ভালো'
আছেন খালেদা জিয়া
লন্ডন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া 'আগের চেয়ে ভালো' আছেন উলেস্নখ করে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, 'আপনারাও পত্র-পত্রিকায় খবর দিচ্ছেন, আমরাও খবর নিয়েছি। উনি (বেগম খালেদা জিয়া) মানসিক দিক দিয়ে, শারীরিক দিক দিয়ে, আলহামদুলিলস্নাহ আগের চাইতে অনেকটা বেটার।'
৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। উন্নত চিকিৎসকার জন্য গত ৮ জানুয়ারি তাকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জন প্যাট্রিক কেনেডির তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনকে লন্ডনে নিয়ে যেতে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি নিজের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠান, সেই উড়োজাহাজে খালেদা জিয়া লন্ডনে যান। সেখানকার চিকিৎসকরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া চিকিৎসকদের সঙ্গে বসে খালেদা জিয়ার লিভার, কিডনি, হৃদযন্ত্রসহ বিভিন্ন রোগের তথ্য জেনেছেন এবং বাংলাদেশে যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে অবহিত হয়েছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, 'ম্যাডাম আগের চেয়ে ভালো আছেন। রুটিন বিভিন্ন পরীক্ষাগুলো ডাক্তাররা করছেন। যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে তার রিপোর্টের ফলাফল দেখে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এখানে উনার চিকিৎসার ধরনে কিছুটা পরিবর্তনও আনা হয়েছে।'
তিনি জানান, খালেদা জিয়ার জন্য তার ছেলে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসা থেকে রান্না করা খাবার হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যায় এই খাবার হাসপাতালে নিয়ে যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমান নিজে। খালেদা জিয়া তার দুই ছেলের তিন মেয়ে (তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমান, আরাফাত রহমান কোকোর মেয়ে জাহিয়া রহমান ও জাফিয়া রহমান) সার্বক্ষণিক নানির সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।