সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত মানবিক পুলিশ সদস্য জীবন

বোরহানউদ্দিন (ভোলা) প্রতিনিধি
  ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

২২ মার্চ শুক্রবার। ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড। ওই ওয়ার্ডের একটি ছিন্নমূল পরিবারের জন্য একটি টিনের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরের চাবি তুলে দেওয়া হলো ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সের নান্টু মিয়ার পরিবারের হাতে। ওই নান্নু মিয়ার স্ত্রী জয়নব বিবি অশ্রম্নসিক্ত চোখে জানালেন, প্রায় তিন শতক জমির উপর ওই ঘর করে দিয়েছেন পুলিশ সদস্য জীবন মাহমুদ। এখন তাদের বর্ষা আর শীতে কষ্ট করতে হবে না। এখানে আগে তারা চারটি খুঁটির উপর পলিথিন, খড় দিয়ে কোনোরকমে থাকতেন। বর্ষায় ভিজতেন, শীতে জবুথবু হয়ে থাকতেন।

কিছুক্ষণ পর আরেকটি ওয়ার্ডে ৪টি অসহায় পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হলো একটি করে টিনের ঘর করার জন্য যাবতীয় সামগ্রী। সামগ্রী পাওয়াদের মধ্যে আয়েশা ও জামালউদ্দিন জানান, তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছেন জীবন মাহমুদ।

কিছুদূর গ্রামের দিকে আগাতেই দেখা কানন বেগমের সঙ্গে। তার হাতে একটা ছাগল। সঙ্গে দুটি ছাগলের বাচ্চা। তিনি জানালেন, এ ছাগল কিনে দিয়েছেন জীবন মাহমুদ। বাচ্চা দুটি বড় হলে তার মূলধন হয়ে যাবে।

তার একটু আগেই মনিরাম বাজার। ওই বাজারে বাকপ্রতিবন্ধী হাতেম আলী ক্ষুদ্র দোকান করছেন। হাতেম আলী জানালেন, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত টেনেটুনে লেখাপড়া করেছেন। একেতো মুখের কথা অধিকাংশ বোঝা যায় না, অন্যদিকে পড়াশুনায়ও ভালো ছিলেন না। তাই লেখাপড়া আর এগোয়নি। ১০-১২ বছর চাসহ অন্য মালামাল বিক্রির দোকান করেছেন। বাকি নিয়ে কাস্টমার টাকা দেয়নি। খেয়ে না খেয়ে দিন চলছিল। তখন জীবন মাহমুদ এ দোকান করে দেন। এখন পরিবার নিয়ে ভালো আছেন। পাশাপাশি বৃদ্ধ বাবা-মাকেও সেবা করতে পারছেন। যদিও তার দুই ভাই আ. হালিম ওমান ও আ. মতিন সিঙ্গাপুর থাকেন। কিন্তু তারা বাবা-মার খোঁজও নেন না।

মনিরাম বাজার থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে হাসাননগর ইউনিয়নের কাজির হাট-বাজার। সেখানে দেখা যায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শাহিন দোকান করছেন। শাহিন জানান, কয়েক বছর আগে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় তার দুই চোখ নষ্ট হয়ে যায়। সংসারে বাবা নেই। মা আর চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া ছোট বোন। যখন না খেয়ে থাকার মতো পরিস্থিতি, তখন জীবন মাহমুদ এ দোকান করে মালামাল কিনে দেন। দোকানে বিক্রিও ভালো। এখন মা আর বোনকে নিয়ে অনেক ভালো আছেন।

উপজেলার টবগী ইউনিয়নের মুলাইপত্তন গ্রামের জান্নাত বেগমের স্বামী মারা গেছেন প্রায় তিন বছর। স্বামী আ. রাজ্জাক শরিফ ইমামতির বেতনে সংসার চালাতেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন সন্তানের জননী জান্নাত চোখে-মুখে অন্ধকার দেখেন। জান্নাত বেগম জানান, একদিকে সংসারের খরচ, অন্যদিকে সন্তানদের পড়াশোনার খরচের চিন্তায় তার পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। একদিন জীবন মাহমুদ একটি সেলাই মেশিন নিয়ে তার বাড়িতে হাজির হন। টুকটাক সেলাইর কাজ জানেন। বাড়ির আশপাশের মহিলা ও বাচ্চাদের অর্ডার পান। মোটামুটি আয় হয়। আগের চেয়ে ভালো আছেন।

হাসাননগর ইউনিয়নের অটো চালক মিজানুর রহমান, টবগী ইউনিয়নের মো. নয়ন জানান, দুর্র্ঘটনায় তাদের হাত পা কেটে ফেলতে হয়েছে। জীবন মাহমুদ তাদের কৃত্রিম হাত-পা কিনে সংযোজন করে দিয়েছেন।

জীবন মাহমুদ এলাকায় একটি সার্বক্ষণিক অটোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওই অটোর ড্রাইভার কোনো রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার দরকার হলে হাজির হন রোগীর বাসার দরজায়। স্থানীয়রা এটাকে গরিবের অ্যাম্বুলেন্স বলেন।

দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে জীবন মাহমুদের শিক্ষক হাফিজ ইব্রাহিম মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক জাকারিয়া আজম বলেন, 'আমার কাছে মনে হয় জীবন মাহমুদের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা সহজাত। তিনি কলেজে পড়ার সময় অসহায় মানুষকে রক্ত দান করতেন। দরিদ্র কোনো শিক্ষার্থী ফরম ফিলাপ করতে না পারলে তার পাশে দাঁড়াতেন। এখন কর্মজীবনেও যেভাবে দুস্থ মানুষের পাশে আছেন, তা এক কথায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।'

দ্বীপজেলা ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার টবগী ইউনিয়নের ৭ নাম্বার ওয়ার্ডের শাহাবুদ্দিন মিয়ার একমাত্র ছেলে সন্তান জীবন মাহমুদ। তিনি ২০২০ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। বর্তমানে কর্মরত আছেন বরিশালে। পুলিশে যোগদান করার পর রাস্তাঘাটে ডিউটি করতে গিয়ে দুস্থ মানুষের অসহায়ত্বের চিত্র দেখতে পান জীবন মাহমুদ। সামর্থ অনুযায়ী কিছু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর কিছু অসহায় মানুষের চিত্র ফেসবুকে পোস্ট করে সাহায্য চেয়েছেন। অনেকেই এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান। তখন চিন্তা করলেন মানুষের উপকারে ফেসবুক একটি দারুণ পস্ন্যাটফর্ম। এই পস্ন্যাটফর্মকে মানব কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। সেই থেকে শুরু। তিনি বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার পরামর্শ ও রক্তদাতার সন্ধান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানিমূলক বিষয়গুলোতে সাহায্য করা, আইনি সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়া হয়।

এমনকি রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষদের ঘর করে দেওয়া হয়েছে তার বেতন এবং কিছু অনলাইন শুভাকাঙ্ক্ষীর সহযোগিতায়। এখন পর্যন্ত ভোলা ও বরিশাল জেলায় ৪৪টি অসহায় পরিবারকে টিনের ঘর করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন ৫৩ পরিবারের। এ মুহূর্তে ৩৮ জন এতিমকে খাবারসহ এতিমখানার পড়াশোনার বেতন-ভাতা পরিশোধ করছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য আছে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা। এরজন্য প্রয়োজন নেই কোনো জামানত কিংবা খোলা তারিখের। যখন দরকার তখনই পাওয়া যায় এই সুদমুক্ত ঋণ। ১৯ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বর্তমানে সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন।

যেকোনো বিষয়ভিত্তিক সমস্যার সমাধানও দেওয়ার চেষ্টা করেন জীবন মাহমুদ। কারো পুলিশি বা ডাক্তারি সেবা এবং আইনি পরামর্শ লাগলে ফেসবুকে পোস্ট করেন আর মুহূর্তে মিলে পরামর্শ। হয়ে যায় সমস্যার সমাধান, এই ফেসবুক আইডিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রক্তের প্রয়োজনের অনুরোধ আসে। এ পর্যন্ত প্রায় শত শত ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করে দিয়েছেন।

অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে জীবন মাহমুদ বলেন, 'বর্তমানে আমার মানবিক কাজে জুঁই আক্তার নামের এক আমেরিকা প্রবাসী সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেন। তিনি ১৮তম বিসিএস পরীক্ষায় ভেটেনারি সার্জন হিসেবে যোগদান করে পরে চাকরি ছেড়ে সপরিবারে আমেরিকা চলে যান। এছাড়া প্রবাসী পুলিশ, আইনজীবী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে