চলে গেল আরও একটি বছর। শুরু হলো ২০২৫ সাল। বিগত বছরজুড়ে ছিল বহু ঘটনা ও দুর্ঘটনা। তবে বিদায় নেওয়া ২০২৪ ছিল দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছাত্র-জনতার অভু্যত্থান হয়েছে এই বছরে। সংগত কারণে এ ঘটনা শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, আলোচিত ছিল বহির্বিশ্বেও।
২০২৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে বড় ঘটনাগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল বছরের প্রথম দিন শুরু হয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত শিরোনাম হওয়ার মাধ্যমে। এদিন ড. ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের অন্য তিন কর্মকর্তাকে ঢাকার শ্রম আদালত ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেন এবং পরবর্তীতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার শর্তে ১ মাসের জামিন দেন।
আলোচিত-সমালোচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ জানুয়ারি। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবার নির্বাচনে জয়লাভ করে। এতে ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পায়। জাতীয় পার্টি ও আরও কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে। ৯ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করা হয় এবং অবশেষে ১০ জানুয়ারি জয়ী সাংসদরা শপথ গ্রহণ করেন।
নানা ঘটনার বছর ২০২৪ সালের এপ্রিলে দুটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর আলোচনায় আসেন পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন তার সম্পদ তদন্তে কমিটি গঠন করে। এই সূত্র ধরে বেনজির আহমেদ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং ১২ জুন আদালত বেনজির আহমেদ ও তার পরিবারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন।
কোরবানির ঈদের সময় ১২ লাখ টাকায় ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ছাগল কেনার ফেসবুক পোস্ট ঘিরে আলোচনায় আসেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান। সরকারি এক কর্মকর্তার ছেলে কোরবানির জন্য ১২ লাখ টাকায় ছাগল কিনবেন- এই খবরে দেশ জুড়ে চলে আলোচনা- সমালোচনা ঝড় এবং এই ঘটনার জের ধরেই মতিউর রহমানকে পদচু্যত করা হয়।
৫ জুন সংস্কার আন্দোলন বা জুলাই আগস্ট আন্দোলন অথবা ছাত্র-জনতার অভু্যত্থান ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সব থেকে বেশি আলোচিত বিষয়। শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে 'রাজাকারের নাতি-পুতি' হিসেবে অভিহিত করেন। এর পর থেকেই কোটা আন্দোলন আরও জোরদার হয়।
৫ জুন শুরু হওয়া সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ১৫ জুলাই হামলা চালায় ছাত্রলীগ। পরদিন দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ওই দিন নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়জনে। এরপর থেকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
৫ আগস্ট তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বাসভবনে প্রবেশ করে আন্দোলনকারীরা। এ সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।
৬ আগষ্ট বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়। আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর দেশের অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্থণে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নাম ঘোষণার ৩দিন পর ৮ই আগস্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়।
১৯ আগস্ট পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে ফেনী, কুমিলস্না, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কক্সবাজার, লক্ষ্ণীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় বন্যা শুরু হয়। দীর্ঘস্থায়ী ওই বন্যায় অন্তত ৫৯ জন নিহত হন। ক্ষয়ক্ষতি হয় বিপুল পরিমাণ।
নতুন সরকার জুলাই হত্যাকান্ডের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের উদ্যোগ নেওয়ার পর ১৭ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এই আদালত।
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সরকার।
২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর ইসকনের চিন্ময় কৃষ্ণদাশকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। পরদিন ২৬ নভেম্বর তাকে চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়, যেখানে ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলাম তার জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের রিমান্ড শুনানিকে কেন্দ্র করে তার সংঘর্ষে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন। এই মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া সাজার রায় ২ ডিসেম্বর বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ গ্রেনেড হামলা মামলার আসামিরা খালাস পান।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল। ২ ডিসেম্বর ভারতের আগরতলায় দেশটির উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা করে। এ ঘটনার পর বাংলাদেশ তলব করে ভারতের হাইকমিশনারকে।
১৫ ডিসেম্বর বেক্সিমকো গ্রম্নপের কারখানা বন্ধ করা হয়, এতে ৪৫-৫০ হাজার শ্রমিক কর্মসংস্থান হারান।
২৩ ডিসেম্বর মেঘনা নদীতে নোঙর করা সারবাহী একটি জাহাজ থেকে সাতজনের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। এর মধ্যে পাঁচজনকে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। দুজনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।
২০২৪ সালের শেষের দিকে এসে ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এই নিয়ে শুরু হয় দেশ জুড়ে আলোচনা।