বাঁশের তৈরি পণ্য বাঙালির পুরনো ঐতিহ্য। বর্তমানে পস্ন্যাস্টিক ও পলিথিন সামগ্রীর সহজলভ্যতায় পুরনো এই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু পূর্ব পুরুষের এই পেশাকে এখনও ধরে রেখেছেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পূর্ব স্বরমঙ্গল গ্রামের দূর্গা রানী দাস (৫০)। এখনো বাঁশ কেটে ডালা, কুলা, চালুনি, খালুই সহ নানা পণ্য তৈরি করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু দিন দিন বাঁশের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় অর্থ অভাবে পড়ে ভালো নেই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররা। ঐতিহ্যবাহী এই পেশাকে ধরে রাখতে সরকারি সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন তারা।
জীবিকার তাগিদে সাংসারিক কাজের পাশাপাশি বাঁশ ও বেতের তৈরি কুলা, চালুন, খাঁচা, মাচা, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুঁড়ি, ডুলা, মোড়া, মাছ ধরার চাঁই, মাথাল, সোফাসেট, বইপত্র রাখারর্ যাকসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, বাঁশের ঘর, বেড়া, ঝাপ, বেলকি, দরমা বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক। দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত বাঁশের তৈরি গৃহস্থালি পাত্রসমূহ খুবই আকর্ষণীয় বিভিন্ন পণ্য তৈরী করে থাকেন নারীরা। সেগুলো বিভিন্ন হাট-বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন পরিবারের পুরুষেরা।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশের বানানো চটা দিয়ে চালুনি তৈরীতে ব্যস্ত রাজৈর উপজেলার পূর্ব স্বরমঙ্গল গ্রামের কুটির শিল্পী শুকুমার দাসের স্ত্রী দূর্গা রানী দাস (৫০)। তার সঙ্গে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন পুত্রবধূ মালা রানী দাস (২৫) ও মেয়ে অপর্ণা দাস (২৮)। তাদের বাবা-দাদার কাছ থেকে শিখেছেন এই কুটিরশিল্পের কাজ। এই কাজের উপার্জনের টাকায় চলে তাদের সংসার। কিন্তু বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির দেশে বাঁশের তৈরি জিনিসের চাহিদা কমে গেছে, বেড়েছে পস্নাস্টিক জিনিসের চাহিদা। এজন্য দিন দিন আর্থিক সংকটে পড়েছেন কুটিরশিল্পীরা। এতে জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। এদিকে সরকারি সহযোগিতার জন্য একাধিকবার নামের তালিকা নিলেও কোন সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি এই ক্ষুদ্র শিল্পীরা। দেশের এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা চান তারা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পরিবেশবান্ধব নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় ও বাণিজ্যিক সামগ্রী তৈরির এ ক্ষুদ্র শিল্পগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার দাবি সংস্কৃত ব্যক্তিদেরও।
নারী কুটির শিল্পী দূর্গা রানী দাস, তার পুত্রবধূ মালা রানী দাস ও মেয়ে অপর্ণা দাস জানান, পরিবারের পুরুষেরা বাঁশ কিনে এনে কেটে চটা বানিয়ে দেয়। পরে আমরা বুনে ডালা, কুলা, চালুনি, খালুইসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করি এবং সেগুলো রঙ করে দেই। একবারে ৫০-৬০ পিচ হলে বিভিন্ন হাটে নিয়ে বিক্রি করা হয়।
তারা আরও জানান, ২০ দিনে ৫০ পিচ বানিয়ে পাইকারি বিক্রি করতে পারলে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা লাভ হয়। এই টাকায় আমাদের সংসার চালাতে কষ্ট হয়। সরকারি ভাবে সহযোগিতার জন্য কয়েকবার নাম নেছে কিন্তু কিছুই দেয় নাই। যদি সরকার আমাদের কোন সহযোগিতা না করে তাহলে আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী কাজ ছেড়ে দিতে হবে।
দুর্গা রানী দাসের স্বামী কুটির শিল্পী শুকুমার দাস (৫৫) জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে বাঁশের দাম বেড়েছে। তাই প্রতিটি জিনিস তৈরিতে খরচ হয় ৫৫-৬০ টাকা, আর ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারি। এতে প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা থাকে। তা দিয়ে ভালভাবেই চলা যায়। এখনো বাঁশের তৈরি বেশ কিছু জিনিসের চাহিদা আছে। কিন্তু টাকার অভাবে তৈরি করতে পারছি না, তাই বিক্রিও কম হচ্ছে। সরকারি আর্থিক সহযোগিতা পেলে ভাল করে ব্যবসা করা যেতো এবং বাবা-দাদাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারতাম।
রাজৈর উপজেলার ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠক এস এম আজিজুল হক বলেন, বহির্বিশ্বে হাতে যারা কাজ করে এই সকল শিল্পীদের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তুলে এনে ট্রেনিং করিয়ে এবং আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শিল্প বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু বাংলাদেশে কোন সংস্কৃতি বা শিল্পের কদর নেই। অর্থের অভাবে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য কুটিরশিল্প আজ হারাতে বসেছে। কুটির শিল্পীদের যদি আর্থিক সহযোগিতা না করা হয় তাহলে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজুল হক বলেন, ইতোমধ্যে বাঁশ ও বেত শিল্পীদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। এই কাজগুলোকে আরও বেগবান করতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তারা যেন কুটির শিল্পের কাজ সুন্দর ভাবে করতে পারে সেই লক্ষ্যে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য দ্রম্নতই সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হবে।