বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

মধুপুরে আনারসের পরিত্যক্ত পাতায় উন্নতমানের ফাইবার

অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে দরকার পৃষ্ঠপোষকতা কর্মসংস্থানের সুযোগ ও বিদেশে রপ্তানিতে ভূমিকা রাখতে পারে
মধুপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
  ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
মধুপুরে আনারসের পরিত্যক্ত পাতায় উন্নতমানের ফাইবার
মধুপুরে আনারসের পরিত্যক্ত পাতায় উন্নতমানের ফাইবার

লাল মাটির মধুপুর গড় অঞ্চল আনারসের রাজধানী হিসেবে ইতিহাস ঐতিহ্য খ্যাত। একটি আনারসের গাছে বছরে একবার আনারস আসে। পরের বছর গাছের কান্ড ও ডাঁটা থেকে চারা বের হয়। মূল গাছে আর আনারস ধরে না। কান্ড থেকে আসা কুশি গাছে ফল ধরে। আর ডাঁটিতে এক সঙ্গে অনেকগুলো চারা আবার আহরণ করে জমিতে রোপণ করা হয়। মূল গাছ অবিক্রিত বা ফেলনা হিসেবে থেকে যায়। পাতাগুলো মরে নষ্ট হয়ে যায়।

এবার এই পাতাকে কাজে লাগিয়ে মধুপুর গড়ে তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের ফাইবার। ফাইবারকে কাজে লাগিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে তৈরি হচ্ছে উন্নতমানের পা পোস, সুতা, ব্যাগসহ নানা শৌখিন তৈজসপত্র। ফাইবার ও শৌখিন তৈজসপত্র যাচ্ছে দেশের বাইরেও। আনারসের পাতাকে ঘিরে গড় অঞ্চলে দেখা দিয়েছে অপার সম্ভাবনা। ফাইবার তৈরির কাজে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে স্থানীয় বেকার নারী পুরুষ শ্রমিকদের। বৃহৎ পরিসরে এ অঞ্চলের আনারসের পাতাকে কাজে লাগাতে পারলে গড় অঞ্চলে গড়ে উঠতে পারে শিল্প কারখানা। ফাইবারে তৈরিকৃত শৌখিন তৈজসপত্র দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা যেতে পারে বিদেশেও। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নতুন দ্বার খুলে যেতে পারে।

সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আনারসের পাতাও হতে পারে সুন্দর বনের গোল পাতার মতো ঐতিহ্যবাহী। আর কৃষি বিভাগ বলছে, মধুপুরে প্রচুর পরিমানে আনারস চাষ হয়ে থাকে। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ফাইবার তৈরিতে কাঁচামালের কোন অভাব হবে না। হতে পারে স্থানীয় নারী পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধুপুর গড় অঞ্চলের আউশনারা ও মহিষমারা ইউনিয়নে ব্যক্তি উদ্যোগে আনারসের পাতা দিয়ে ফাইবার তৈরি হচ্ছে। ফেলনা পাতা কুড়িয়ে বা বাগান থেকে অটো বাইকে নিয়ে এসে ফাইবার বানানো হচ্ছে। এতে কাঁচামালের কোন অভাব হচ্ছে না। স্বল্প খরচে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে পাতা। কারখানায় এনে গাছ থেকে কেটে পাতাগুলো আলাদা করে মেশিনে দিয়ে ফাইবার তৈরি করা হচ্ছে। তাদের মতে, ফেলনা পাতা দিয়ে উন্নতমানের ফাইবার তৈরি করা যাচ্ছে। শ্রমিক মজুরিও কম। বাড়ির কাছে থাকায় নারীরাও কাজ করে পাচ্ছেন মজুরি। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্প কারখানা স্থাপনের দাবি তাদের।

সরজমিনে মহিষমারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আনারসের পাতা দিয়ে আঁশ তৈরি করার দৃশ্য। দূর থেকেই শোনা যায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মতো খটখট শব্দ। চারদিকে টিনের ভেড়া। ভেতরে করা হয়েছে আঁশ বের করার মেশিন। রোদে শুকানো হচ্ছে পাটের মতো সাদা সাদা আঁশ। দেখতে অনেকটা পাটের আঁশের মতো। তবে সাইজে পাটের চেয়ে ছোট। দুই হাত লম্বা সাইজের আঁশগুলো বাঁশের আড়ে শুকানো হচ্ছে। টিনের ঘরে কয়েকজন নারী শ্রমিক আঁশের ময়লা পরিস্কার করে সমান করে কেটে নিচ্ছেন। সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখা যায়, ৮ থেকে ১০টি মেশিনে পাতা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কয়েকবারে বের হচ্ছে আঁশ। পেছনে বসে কয়েকজন নারী শ্রমিক আনারসের পাতা সুন্দরভাবে ভাঁজ করে দিচ্ছেন মেশিনে থাকা নারী শ্রমিকের হাতে। পাশে কয়েকজন আঁশগুলো হাউজে ধুয়ে নিচ্ছেন। পরিস্কার ধুয়ে নেওয়া আঁশ রোদে শুকানো হচ্ছে। দারুণ কিন্তু সহজেই আনারসের পাতা দিয়ে আঁশ তৈরির এমন দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কারখানার মালিক জানালেন, এ আঁশগুলো বায়ারদের কাছে বিক্রি করেন। বিদেশে যায় এ আঁশ, তাই ছবি তোলা যাবে না। তারমতে, ছবি তুললে এ প্রযুক্তি অনেকেই জেনে যাবে। এতে আরও কারখানা গড়ে উঠতে পারে। কারখানার কয়েকজন নারী শ্রমিক জানালেন, বাড়ির কাছে থাকায় তারা কাজ করেন। এতে যে মজুরি আসে তা দিয়ে স্বামীর উপার্জনের সঙ্গে যোগ করে সংসার চলে।

মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রকিব আল রানা জানান, লাল মাটির গড় অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে আনারস চাষ হয়। আনারসের পাতা থেকে আঁশ তৈরি করা একটা সম্ভাবনাময় শিল্প। ফেলনা পাতা দিয়ে আঁশ বা সুতা তৈরি করাকে কাজে লাগাতে পারলে আনারসের মতো আঁশও হতে পারে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনাময়। একদিকে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে উন্মুক্ত হবে আনারসের পাতাকে ঘিরে শিল্পের নতুন দ্বার। এতে আনারসের মতো মধুপুর গড়ের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। এমনটাই মনে করছেন এই কর্মকর্তা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে