বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২

নবীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীতে বালু মহাল নিয়ে চলছে হরিলুট

নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি
  ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
নবীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীতে বালু মহাল নিয়ে চলছে হরিলুট
নবীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীতে বালু মহাল নিয়ে চলছে হরিলুট

হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীতে বালু মহাল নিয়ে চলছে তুলকালাম কান্ড। সরকারি নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও সেগুলো অমান্য করে যথেচ্ছা বালু তুলছে এক শ্রেণির প্রভাবশালী বালু খেকো চক্র। ইজারা করা বালু মহালের সরকারি নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে গিয়ে বালু তোলায় ক্ষতিগ্রস্ত নদী ও এর আশপাশের জনপদ। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে প্রতি বছর নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার একর জমি, বিলীন হচ্ছে বসতভিটা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন অংশ।

নিয়ম নীতি ও আইনের তোয়াক্কা না করে যৌথবাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রকাশ্যে নদীর বিভিন্ন স্থানে ১৫-২০টি কাটার মেশিন দিয়ে দিনরাত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে বালু খেকোরা। এক মাসের বেশি সময় ধরে নির্বিচারে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে ওই চক্র। প্রশাসন মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করলেও থামছে না বালু উত্তোলন। ফলে নদী তীরবর্তী বাড়িঘর, ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে জাতীয় পাওয়ার গ্রিডের বৈদু্যতিক সঞ্চালন কেন্দ্র বিবিয়ানা পাওয়ার পস্নান্ট, কয়েকটি স্কুল, মসজিদ, মাদরাসা ও হাট-বাজারের বিভিন্ন স্থাপনা। অভিযোগ রয়েছে বেশিরভাগ এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে এসব বালু উত্তোলন হচ্ছে। যে কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত ও অতিষ্ট হলেও মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় ফলাও করে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ হলেও তার তোয়াক্কা করছেন না কেউই।

জানা গেছে, নবীগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর চরে বালু মহালে অবৈধ ভাবে বালু তোলা নিয়ে গত ২৪ জানুয়ারী দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়। ঢাকার ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে বলে এলাকায় প্রচার করে আসছে। তারা বালু উত্তোলন করার জন্য ওইদিন লোকজন নিয়ে কুশিয়ারা নদীতে ড্রেজার বসানোর জন্য পাহাড়পুর ও বনগাওয়ের নিকটস্থ নদীর তীরে গেলে স্থানীয়রা বাঁধা দেয়। এ সময় দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

এ ব্যাপারে ওয়াহিদ এন্টারপ্রাইজের সুপারভাইজার রাজিবুর রহমান বলেন, 'আমরা বিআইডবিস্নউএ এর অনুমতি পেয়ে বালু তোলার জন্য গেলে একটি পক্ষ বাঁধা দেয়।' কিন্তু তারা যথাযথ কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হন।

অপরপক্ষের বালু উত্তোলনকারী পারকুল গ্রামের ছাত্রদল নেতা সাজু আহমদ জানান, তিনি প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বালু উত্তোলন করছেন, তার অনুমতি ছাড়া আর কেউ বালু তোলার কথা নয়। কাগজ পত্র দেখানোর কথা বলা হলে তিনি বলেন এসব সময় মতো দেখানো হবে।

হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নবীগঞ্জ উপজেলায় কয়েকটি বালু মহাল রয়েছে। এর মধ্যে নবীগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর যে কয়েকটি বালু মহালটি রয়েছে, তার মধ্যে কয়েক বছর ধরে কোনো ইজারা দেওয়া হয়নি। অথচ এই বালু মহাল থেকে অবৈধভাবে প্রতি বছর কোটি টাকার বালু উত্তোলন হলেও বিপুল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সরকার থেকে যে নির্দিষ্ট সীমানা রয়েছে, তা অতিক্রম করে নিজেদের খেয়াল খুশিমতো যে কোনো স্থান থেকে প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করে চলেছেন বালু খেকোরা। বিভিন্ন সময় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে এদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।

এদিকে, উপজেলার তাজাবাদ বালু মহাল যে এলাকায় প্রজেক্ট রয়েছে সে এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন করায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অপরাধীদের অর্থদন্ড দেওয়া হয়।

বিবিয়ানা বিদু্যৎ পাওয়ার পস্নান্টের পাশে ১০টি ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করে বাল্কহেডে ভরা হচ্ছে। এসব বালু বাল্কহেডে ও পাইপের মাধ্যমে শেরপুর অর্থনৈতিক জোনের পাশে খালি জমির মধ্যে রেখে অন্যত্র নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভাঙনে নদীতে চলে গেছে একটি মসজিদ, বহু কৃষিজমি ও কয়েকটি গ্রামের শতাধিক বসতবাড়ি। ভাঙনের ঝুঁকিতে ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুইটি মসজিদ ও ঝুঁকির মধ্যে বিবিয়ানা পাওয়ার পস্নান্ট।

ভাঙনের শিকার ছলিম উদ্দিন বলেন, 'এখন শীতকাল চলছে। সাধারণত নদী ভাঙন কম থাকে। কিন্তু নদীতে ড্রেজারে বালু তোলার কারণে পাড় ভাঙছে। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে ভাঙন তীব্র হয়েছে। ফলে কয়েকটি পরিবার মিলে অন্যত্র সরে যাচ্ছি।'

এছাড়া নদীর ওপর দিয়ে যাওয়া জাতীয় গ্রিডের ৩৩ কিলো. ভোল্টের বৈদু্যতিক সঞ্চালন লাইনটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসী আতঙ্কে দিন পার করছেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপম দাস অনুপ বলেন, 'আমরা যাওয়ার আগেই তারা খবর পেয়ে সেখান থেকে সটকে পড়ে। বালু তোলার মূলহোতাদের ধরার চেষ্টা চলছে।'

হবিগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক ড. মো. ফরিদুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসন নবীগঞ্জের কুশিয়ারা নদী থেকে বালু উত্তোলনের কোন অনুমতি দেয়নি। অনুমতি ছাড়া কেউ বালু উত্তোলন করার কথা নয়। বিআইডবিস্নউএ কাউকে অনুমতি দিয়েছে কিনা জানা নেই।

বিআইডবিস্নউএ'র চেয়ারম্যান আরিফ আহমেদ মোস্তফার মোবাইল ফোনে কল দিলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার প্রধান সমন্বয় কর্মকর্তা আশরাফুর রহমান বলেন, 'অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কোনো তালিকা আমাদের কাছে নেই। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগও নেই। বিষয়টি সম্পূর্ণ জেলা প্রশাসনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। আমাদের কাছে বালু উত্তোলনের জন্য কিছু আবেদন এসেছে। এগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে উপ-পরিচালক অনুমোদন দেবেন। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কোন সুযোগ নেই।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে