মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

'ব্রেস্ট ফিডিং' নিয়ে বিপাকে মায়েরা

দেশে পালিত হলো বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ
শামীম আহমেদ
  ০৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

উন্নয়ন কর্মী রীমা আক্তার চৌধুরী ৫ মাসের সন্তান নিয়ে স্বামীর সঙ্গে সড়কপথে ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে বাচ্চাটি কান্না শুরু করে। তারা খেলনা দেখিয়ে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করেন। এক সময় তারা বুঝতে পারেন, ক্ষুধার্ত শিশুটি মায়ের বুকের দুধের জন্য কান্না করছে। পরে তারা কিশোরগঞ্জের ভৈরবে একটি রেস্টুরেন্টে যাত্রাবিরতি করেন। রেস্টুরেন্টে ঢুকে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। কারণ সেখানে 'ব্রেস্ট ফিডিং' কর্নার ছিল না।

অথচ 'মায়ের দুধ পান : শিক্ষা ও সমর্থনের পদক্ষেপ'- এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে নানা আয়োজনে দেশে 'বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ' পালিত হয়েছে। মায়ের দুধের প্রয়োজনীয়তা ও শিশুর স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে বিশ্বব্যাপী এ সপ্তাহ পালনের তালিকায় বাংলাদেশ উন্নত অবস্থানে রয়েছে।

জানা যায়, ওয়ার্ল্ড ব্রেস্ট ফিডিং ট্রেন্ডস ইনিশিয়েটিভের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ অনুযায়ী বাংলাদেশ ৯৭টি দেশের মধ্যে ৯১.৫/১০০ স্কোর পেয়ে সারা বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করে গ্রিন জোনে আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল সায়েদাবাদ, মহাখালী ও গাবতলীতে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার নেই। তাছাড়া ঢাকা-সিলেট কিংবা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোনো রেস্টুরেন্টেও ব্রেস্ট ফিডিংয়ের সুবিধা নেই। ফলে সন্তানকে বুকের দুধ পান করাতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় মায়েদের।

এদিকে অফিস, রাজধানীসহ দেশের উলেস্নখযোগ্য শপিংমল কিংবা হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার না থাকায় সন্তানকে বুকের দুধ পান করাতে মায়েদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বাধ্য হয়ে শিশুদের দুধের বিকল্প নানা অস্বাস্থকর খাবার খাওয়ানোর দিকে ঝুঁকছেন মায়েরা। এতে ঝুঁকিতে পড়ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থাৎ শিশুরা।

শিশুর জন্মের প্রথম ৬ মাস ব্রেস্ট ফিডিংয়ের সময়। এ সময় শুধু মায়ের বুকের দুধ ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ানো শিশুর জন্য ক্ষতিকর। বুকের দুধ খাওয়ালে শিশুরা যেমন উপকৃত হয়, তেমনি মায়েদের জন্যও এটি বেশ উপকারী। ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ফলে মায়েদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমে বলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা মনে করেন।

গবেষকরা বলছেন, শিশুকে মায়ের দুধ পান না করালে নিউমোনিয়াজনিত মৃতু্যর ঝুঁকি প্রায় ১৫ গুণ, ডায়রিয়ায় প্রায় ১১ গুণ, শিশুদের অপুষ্টি ও অন্যান্য কারণে প্রায় ১৪ গুণ। এছাড়া জন্ডিস, কানপাকা ও পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণের শঙ্কা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে শারীরিক বৃদ্ধি ও বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, বয়সের তুলনায় ওজন এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

রংপুর প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. রেজওয়ানা আফরিন রুপা জানান, সন্তান জন্মের ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধের বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে বুকের দুধ পান করার কিছু নিয়মও রয়েছে। বিশেষ করে দুধপান করার সময় সন্তানের মাথা কিছুটা উঁচু করে রাখতে হয়। যাতে সন্তানের গলায় আটকে না যায়।

তিনি আরও বলেন, নানা কারণে সন্তান নিয়ে মায়েদের বাইরে বের হতে হয়। বিশেষ করে কর্মজীবী মায়েরা সন্তান নিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় বিড়ম্বনায় পড়েন। পাবলিক পেস্নসে সন্তানকে দুধপান করাতে গিয়ে নানা বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন অনেক মা। এক্ষেত্রে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার অত্যন্ত জরুরি।

জানা গেছে, মায়ের দুধ খাওয়ানোর গুরুত্ব সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করার জন্য ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে 'বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ' পালিত হয়ে আসছে। ২০১০ সাল থেকে এ সপ্তাহ জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরেকটি নির্দেশনা ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, সরকারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রেলওয়ে স্টেশন ও বাস টার্মিনাল, শপিংমলসহ প্রত্যেকটি জনবহুল জায়গায় ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন করা। এদিকে, ২০১৯ সালে এ বিষয়ে হাইকোর্টও একটি নিদের্শনাও জারি করে। অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও ওই দুই নির্দেশনা মেনে কিছু হাসপাতাল বা অফিস ছাড়া অন্য কোথাও ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন করা হয়নি।

শিশুর জন্মের পর মা ও শিশুর শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। সেজন্য ছুটতে হয় চিকিৎসকের কাছে। দেশে হাসপাতালের সংখ্যা ৫ হাজার ৮১৬টি। তার মধ্যে মাত্র ৬শ' হাসপাতাল শিশুবাবন্ধব বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে জানা গেছে। ঢাকার অর্ধশতাধিক হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, অধিকাংশ হাসপাতালে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার নেই। যে কয়েকটি হাসপাতালে আছে তার অবস্থাও খুব নাজুক।

এ বিষয়ে কথা হয় ফাতেমা নামে এক গৃহবধূর সঙ্গে। তিনি বলেন, জনসমাগম স্থলে আলাদা স্মোকিং জোন থাকলেও ব্রেস্ট ফিডিং ও বেবি কেয়ার কর্নার নেই, যা বৈষম্যমূলক। তাই সরকারের কাছে তিনি ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার নির্মাণের দাবি জানান।

বেসরকারি চাকরিজীবী আফছানা জাহান বলেন, আমাদের দেশে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে বের হওয়াই সমস্যা। বাচ্চা দুধ খাওয়ার জন্য কাঁদে। কিন্তু মায়ের কিছু করার থাকে না। তাছাড়া বাচ্চাকে কোথাও শুইয়ে দিয়ে ডায়াপার পরিবর্তন করারও কোনো ব্যবস্থা নেই।

অন্যদিকে ঢাকার অধিকাংশ মার্কেটে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার না থাকার কারণে ছোট শিশুদের নিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহবধূ বলেন, 'আমার বাচ্চা নিয়ে একবার নিউ মার্কেটে গিয়ে সমস্যায় পড়ি। তখন সে মাত্র ১১ মাসের শিশু। বাইরের সব খাবার খেতে পারে না, অন্যদিকে বোতলের (ফিডার) দুধও পান করে না। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর তার খিদে লাগলে সে কান্না শুরু করে। পড়লাম মহাবিপাকে! কই যাই, কি খাওয়াই। যেহেতু আমি ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী ছিলাম, তাই শেষ পর্যন্ত কলেজে মেয়েদের হোস্টেলে গিয়ে ডাইনিংয়ে বসে বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিডিং করালাম। শুধু মার্কেট নয়, ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় যেতে যাত্রাবিরতির হোটেলগুলোতেও এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।'

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ঢাকা দক্ষিণের সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, 'কর্মক্ষেত্রে এবং যাত্রাপথের বিভিন্ন স্থানে যদি শিশুকে স্বাচ্ছন্দ্যে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর পরিবেশ থাকে, তাহলে আমাদের মেয়েদের পক্ষে বাইরে আসা আরও সহজ ও গতিময় হবে। এতে দেশের অগ্রযাত্রায় নারীর বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে